কুকি-চিন সমস্যা সমাধানে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন

বান্দরবান প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৩, ২০:০৬

শান্তি প্রতিষ্ঠার কমিটির সংবাদ সম্মেলন। ছবি: বান্দরবান প্রতিনিধি
বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষের জেরে এলাকায় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও কেএএন সশস্ত্র সদস্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ায় সব পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করা সদ্য গঠন হওয়া ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি’।
আজ বৃহস্পতিবার (২২ জুন) সকালে বান্দরবান জেলা পরিষদের সভা কক্ষে আয়োজন করা সংবাদ সম্মেলন এ কথা জানান শান্তি প্রতিষ্ঠার কমিটির মুখপাত্র ও জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা।
তার লিখিত বক্তব্যের আগে বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির আহবায়ক ক্য শৈ হ্লা মারমা বলেন, ২৯ জুন শহরে অরুণ সারকি টাউন হলে সকল সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি নিয়ে একটা মতবিনিময় সভা করা হয়েছিল। সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য একটি কমিটি গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছিল সবাই। কিছুসংখ্যক বম ছেলে-মেয়ে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। তাদেরকে কিভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে কাজ করার জন্য এই শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পরে লিখিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বান্দরবানে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও তাদের সামরিক শাখা কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মির (কেএনএ) নানাবিধ তৎপরতায় বেশ কয়েকটি অঞ্চল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। এসব তৎপরতা নিয়ন্ত্রণে সরকারি বাহিনীগুলোকে অভিযান পরিচালনা করতে হচ্ছে। এর ফলে স্থানীয় জনজীবনে অস্থিরতা ও নিরপাত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে। জীবনযাপনের জন্য জুমচাষ বন্ধসহ জীবিকার সকল পথ বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে পড়েছে। একই কারণে বন্ধ হয়ে গেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পর্যটন এলাকাগুলোতে দেশী-বিদেশী পর্যটক ভ্রমণও। এতে স্থানীয়দের বিকল্প আয়ের পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে।
‘‘ইতিমধ্যে বিভিন্ন ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে দেশপ্রেমিক সেনা সদস্য ও স্থানীয় নিরীহ জনগণ। কুকি-চিনদের সদস্যদেরও হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। জীবন হারানোর এসব ঘটনা এখনো চলমান। আমাদের জানা মতে, নিজেদের জন্য একটি বিশেষ অঞ্চল প্রতিষ্ঠার দাবিতে বিপথগামী কিছু বম যুবক অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। তাদের দাবি অনুযায়ী পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমী এবং ম্রো জনজাতিসহ আরো অনেকে তাদের সাথে রয়েছে। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এসব দাবি-দাওয়া আলোচনার মধ্যে না গিয়ে সরাসরি অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়ায় সমস্যাটি সংকটের রূপ নিয়েছে।’’
‘‘সে অবস্থার সবাই পরিবর্তন চাই। এ কারণে জেলা পরিষদ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিয়ে বম সোশ্যাল কাউন্সিল ও অন্যান্য সামাজিক সংগঠনদের নিয়ে একটি শান্তি উদ্যোগ হাতে নেওয়া হয়েছে। এ শান্তির উদ্যোগ সরকার পক্ষ এবং কেএনএফ ও কেএনএ সদস্যরা সমর্থন করে। শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে প্রাথমিক যোগাযোগে সবার কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি।’’
তবে উদ্যোগটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে হলেও সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি রূপরেখা নিরূপণে সফল হবে জানিয়ে মুখপাত্র কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, এর আগেও পার্বত চট্টগ্রামে দুই যুগেরও বেশি বিরাজমান সমস্যা সমাধান হয়েছে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে। খুব শিগগির শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা শুরু করা হবে।
সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে কমিটির পক্ষ থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করার জন্য একটি লিখিত কর্মপরিকল্পনাও তুলে ধরা হয়। তাদের এই কর্মপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করা। শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মাধ্যমে একটি লিয়াজো কমিটি গঠন করে কেএনএ-এর সঙ্গে জড়িত সকল সদস্যদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে নিয়ে আসার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ। সংঘটিত ঘটনার প্রেক্ষিতে সাধারণ জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অতি শীঘ্রই বন্ধ হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। এলাকায় ক্ষয়-ক্ষতির একটি হিসাব তৈরি করা। এলাকার সাধারণ মানুষ যাতে নিজগৃহে ও ক্ষেত খামারে ফিরে আসতে পারে সে লক্ষ্যে অনুকূল পরিবেশ তৈরি উদ্যোগ গ্রহণ করা।
সংবাদ সম্মেলনে ১৮ সদস্য বিশিষ্ট শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমিটির সদস্য সচিব ও বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক লালজারলম বম, কমিটির সদস্য ও বম সোশ্যাল কাউন্সিলের উপদেষ্টা রেভারেন্ট পাকসিমবয়ত্লুং বম, জেলা পরিষদের সদস্য ও ম্রো সোশ্যাল কাউন্সিলের উপদেষ্টা সিংইয়ং ম্রো, বাংলাদেশ খুমী কল্যাণ অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা লেলুং খুমী, প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মনিরুল ইসলাম মনু ও সাংবাদিক বুদ্ধজ্যোতি চাকমা।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বান্দরবান জেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ); যা ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত একটি সশস্ত্র সংগঠন অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে গত বছর অক্টোবর মাসে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র্যাব।
এরপর অক্টোবর মাস থেকে জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার অভিযান চালায় র্যাব ও সেনা সদস্যের যৌথ বাহিনী। পরবর্তীতে এ অভিযান চালানো হয় থানচি উপজেলাতেও। ইতিমধ্যে অভিযান চালাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন সেনা সদস্যরাও। র্যাবের অভিযানে গ্রেপ্তার হয়েছেন কেএনএফ ও জঙ্গি দলেও সদস্যরাও।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে কয়েক দফা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়ানোর পর রোয়াংছড়ি, রুমা ও থানচি উপজেলায় এখনো অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশী-বিদেশী পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।