শতবর্ষী ১২৯টি গাছ কাটার চূড়ান্ত বন্দোবস্ত করছে পাউবো

খান রুবেল, বরিশাল
প্রকাশ: ২০ জুলাই ২০২৩, ১৯:৪৬

শতবর্ষী বৃক্ষ। ছবি: বরিশাল প্রতিনিধি
বরিশাল নগরীর বান্দরোডে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাগরদী ও চাঁদমারী বিআইপি কলোনির গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে সবুজের সমারোহ। সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে বহুজাতীয় শত শত গাছ।
স্বাধীনতার পূর্বে লাগানো বর্তমানে বিশাল আকৃতির এই গাছগুলো পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যেমন ভূমিকা রাখছে তেমনি, প্রচণ্ড গরমে শীতল, আর প্রাকৃতিক দুর্যোগে রক্ষা করছে কলোনিবাসীকে।
তবে অর্ধ শতাধিক বছরের পুরানো সেই গাছগুলো এখন হত্যার দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে। সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই বিশাল আকৃতির ১২৯টি গাছ কেটে ফেলে বন উজাড়ের চূড়ান্ত বন্দবস্ত করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এরই মধ্যে ঠিকাদারদের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়েছে দরপত্র। হতে পারে দুই-একদিনের মধ্যেই গাছগুলোকে কেটে হত্যার অনুমতি দিবে প্রতিষ্ঠানটি।
আর এ নিয়ে দুই কলোনির বাসিন্দাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মচারী হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পরিবেশ বিরোধী এমন কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে পারছেন না তারা।
এমনকি দায়সারা বক্তব্য দিয়েই এড়িয়ে যাচ্ছেন পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বন বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্তারা। তবে সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই গাছ কেটে বন উজাড়ের বিষয়টিতে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সচেতন মহল। তারা এমন কর্মকাণ্ড থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দপ্তরটির বরিশাল পওর বিভাগের অধীনস্থ সাগরদী কলোনি ও চাঁদমারী বিআইপি কলোনিতে থাকা বিশাল আকৃতির ১২৯টি গাছ নিলামে বিক্রির জন্য চলতি বছরের গত ২২ জুন নিলাম দরপত্র আহ্বান করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সম্প্রতি ঠিকাদারদের কাছ থেকে নিলাম দরপত্র গ্রহণ করেছে তারা। ৪০টির ওপর দরপত্র বিক্রি করা হলেও নিলামে অংশগ্রহণ করেছে চার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে আরিফ নামের একজন নির্ধারিত ১৭ লাখ টাকার অনুকূলে প্রায় ২৪ লাখ টাকা মূল্য দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা হিসেবে এগিয়ে আছেন।
নগরীর সাগরদী এলাকার বাসিন্দা আরিফ নামের ওই যুবক পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমের অনুসারী মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জসীম উদ্দিনের অনুসারী হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতি করেন বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, গুছ প্রক্রিয়ায় গাছের নিলাম পেতে প্রায় ১২ লাখ ব্যয় করেন ওই ব্যক্তি।
এদিকে নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত এবং ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ কর্তন বা অপশনে নিলাম দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। নিলামে দুটি লটে ১২৯টি গাছ বিক্রি করা হবে।
নিলাম দরপত্রে এমনটি দাবি করা হলেও বাস্তব চিত্র পুরোটাই ভিন্ন। সরেজমিনে দেখা গেছে, পানি উন্নয়ন বোডের পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর দপ্তর সংলগ্ন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ের পেছনে ২-৩টি গাছ বন্যায় ভেঙে এবং হেলে পড়েছে। তবে নিলামে বিক্রির জন্য রং দিয়ে নম্বর লিখে চিহ্নিত করা গাছগুলো সম্পূর্ণ অক্ষত। গাছ ব্যবসায়ীদের দাবি, এসব গাছ আরো দীর্ঘ বছর বাঁচবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং বিআইপি কলোনির বাসিন্দা ও কর্মচারীরা অভিযোগ করেছেন, ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকটি গাছ দেখিয়ে ১২৯টি গাছ বিক্রি করছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। যা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। কেননা গাছগুলো বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের পূর্বে লাগানো। এ গাছগুলো দুটি কলোনিকে ছায়া দিচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করছে। এখন গাছগুলো কেটে ফেললে দুটি কলোনিই জলাভূমিতে পরিণত হবে। সেখানে নতুন করে একশত গাছ লাগালেও একটি গাছের ক্ষতিপূরণ করতে পারবে না। তাই পরিবেশের স্বার্থে গাছগুলো বিক্রির বিষয়টি পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এদিকে সরকার যেখানে গাছ লাগানোর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে এবং অকারণে গাছ না কাটার বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিচ্ছে সেখানে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বন উজাড় করতে বৃক্ষ হত্যা কাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবাদী এবং সচেতন মহল।
সামাজিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া অন্যতম সংগঠক বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল- বাসদ বরিশাল জেলার সদস্য সচিব ডা. মনীষা চক্রবর্তী বলেন, গাছ পরিবেশের বন্ধু। যেকোনো কারণেই হোক গাছ কাটা অযৌক্তিক। সরকারই বলে, পরিবেশ রক্ষায় গাছ না কাটার জন্য। সেখানে সরকারি দপ্তরের অকারণে গাছ কাটার উদ্যোগ নিন্দনীয়। বিষয়টি তারা খোঁজ নিয়ে দেখবেন বলে জানান।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) বরিশালের অন্যতম সংগঠক মো. রফিকুল আলম বলেন, চাইলেই গাছ কাটার সুযোগ নেই। তার ওপর সেটা যদি হয় সরকারি সম্পদ। তবে কোন গাছ ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত বা মরে যাওয়ার উপক্রম ঘটেছে সেক্ষেত্রে শুধু ওই গাছগুলোই কাটা যেতে পারে। এর বাইরে কোনভাবেই বৃক্ষ হত্যার সুযোগ নেই।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই ধরণের কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি যখন জেনেছি অবশ্যই আমরা ঘটনাস্থলে যাবো এবং এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) বরিশালের সমন্বয়ক লিংকন বাইয়েন বলেন, গাছ পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তাই চাইলেও গাছ কাটা যাবে না। এ বিষয়ে আমরা কোনভাবেই মত দিতে পারছি না। সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া গাছ কাটা হলে সেটা অবশ্যই আইন পরিপন্থী। তবে উন্নয়নের জন্য হলে সেটা ভিন্ন বিষয়। সেক্ষেত্রে গাছ কাটার বিষয়টি সুস্পষ্ট করতে হবে। কেউ অভিযোগ দিলে অবশ্যই আমরা সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করবো।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) বরিশাল জেলার সভাপতি অধ্যাপক গাজী জাহিদ বলেন, এমনেতেই আমাদের দেশে বনভূমি ক্রমশই কমে যাচ্ছে। তার ওপর সরকারি প্রতিষ্ঠানের এক সঙ্গে এতোগুলো গাছ কেটে ফেলার বিষয়টি উদ্বেগজনক।
তিনি বলেন, বিশেষ কারণে সরকারি গাছ কাটতে হলে অবশ্যই পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বন বিভাগের অনুমতি নিতে হবে। গাছ কাটার উপযোগী হলেই সেটা কাটা যাবে। তবে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, ভেঙে গেছে, এটা বাজে অজুহাত। কেননা সরকারের নির্দেশনা আছে চাইলেই বৃক্ষ কর্তন করা যাবে না। আর এই বিষয়টিতে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বন বিভাগ বড় ভূমিকা রাখবে। তারা কোনভাবেই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারে না। তাই বৃক্ষ হত্যার মতো পরিবেশ বিরোধী এমন কর্মকাণ্ড থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি।
এদিকে গাছ কাটার বিষয়টি একান্তই স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানের বিষয় বলে দাবি করেছেন সামাজিক বন বিভাগ বরিশাল বিভাগের বন কর্মকর্তা ও উপ-বন সংরক্ষক ড. মো. আ. আউয়াল বলেন, গাছ কাটা আটকানো আমাদের দায়িত্ব নয়। আমাদের দায়িত্ব গাছের মূল্য নির্ধারণ করা। পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে আমাদের গাছে মূল্য নির্ধারণ করে দিতে বলেছে, আমরা সেটাই করেছি।
অপরদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক এএইচএম রাশেদ বলেন, গাছ কাটা বা আটকানো আমাদের দায়িত্ব নয়। তাছাড়া গাছ কাটতে হলে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন অনুমতির প্রয়োজন মনে করে না কেউ। এমনকি পানি উন্নয়ন বোর্ড যে গাছগুলো কাটছে সে বিষয়েও আমাদের কিছু জানায়নি।
এ প্রসঙ্গে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাকিব হোসাইন বলেন, যেই গাছগুলো নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে সেগুলো ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত। তাই নিলামে বিক্রি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বন বিভাগের অনুমতি রয়েছে। বন বিভাগ আমাদের শর্ত দিয়েছে একটি গাছ কাটলে দুটি লাগাতে হবে। আমরা সেই শর্ত মেনেই বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছি।
কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা না থাকা সত্যেও কেন গাছ কাটা হচ্ছে এবং ক্ষতিগ্রস্ত নয়, এমন গাছ কেন নিলামের আওতায় আনা হলো? এমন প্রশ্নে পূর্বের বক্তব্য ঘুরিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, মানুষের মতো গাছেরও বেঁচে থাকার একটি নির্ধারিত সময় আছে। যেই গাছগুলো কাটা হচ্ছে সেগুলো পূর্ণবয়স্ক। এখন মরে যাচ্ছে। তাছাড়া অনেক গাছের ডালপালা ঝড়ে ভেঙে গেছে। এজন্য সেগুলোও বিক্রি করা হচ্ছে। ডালপালার জন্য গাছ কাটা হবে কেন? এমন প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারলেও এই কর্মকর্তা বলেন, ভবিষ্যতে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হতে পারে বিধায় গাছ কাটা হচ্ছে।
অক্ষত গাছ নিলামে বিক্রি করার বিষয়টি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জানেন কিনা? এমন প্রশ্নে নির্বাহী প্রকৌশলী বলেন, হ্যাঁ অবশ্যই, পানি উন্নয়ন বোর্ড এবং মন্ত্রণালয়সহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেয়েই গাছগুলো কাটা হচ্ছে।
এদিকে সামাজিক বন বিভাগের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, ২০২২ সালেও ওই গাছগুলো নিলামে বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ড। তবে ওইসময় গাছ কাটার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখাতে পারেনি তারা। এ কারণে তাদের গাছ কাটার অনুমতি দেওয়া হয়নি। তাছাড়া গাছ কাটার বিষয়ে বর্তমান সিটি মেয়রের আপত্তি থাকায় সে দফায় রক্ষায় পায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের অর্ধ শতবর্ষী গাছগুলো। তবে একই গাছ নতুন করে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেখিয়ে বিক্রি এবং হত্যার পায়তারা ক্ষুব্ধ করেছে সচেতন মহলকে।