কেএনফের সাথে আলোচনার প্রস্তাব শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির

বান্দরবান প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৩, ১৬:০৬

কেএনএফ-এর সাথে দ্বিতীয় দফা সংলাপে জেলা পরিষদের সভা কক্ষে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যরা। ছবি: বান্দরবান প্রতিনিধি
পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএফ) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে সংঘাতের জেরে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রতিষ্ঠা হওয়া ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও কেএনএফের’ মধ্যে দ্বিতীয় দফা ভার্চুয়াল সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জেলা পরিষদের সভাকক্ষে আজ শুক্রবার (৪ আগস্ট) সকাল দশটায় শান্তি প্রতিষ্ঠার কমিটির সাথে পাহাড়ে সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের সাথে দ্বিতীয় দফা এই সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় বলে জানান শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র ও বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা।
তিন ঘন্টাব্যাপী এই ভার্চুয়াল সংলাপে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে কেএনএফর সাথে এবার সরাসরি আলোচনা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয়। তার আগে ১৯ জুলাই শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি ও সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফর মধ্যে প্রথমবারের মত ভার্চুয়াল সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়।
এবার দ্বিতীয় দফার সংলাপ শেষে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির মুখপাত্র ও বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, কেএনএফ যেসব বিষয়ে দাবি তুলেছিল সেগুলো লিখিত আকারে পাঠাতে বলা হয়েছিল। তারা এখনো পাঠাতে পারেনি। তারা সেগুলো সিদ্ধান্ত নিয়ে পাঠানোর কথা বলেছে। এছাড়া কেএনএফের সাথে সরাসরি বৈঠক করার প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। সে বিষয়েও তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে জানানোর কথা বলেছে। শান্তি প্রতিষ্ঠার সংলাপ চলমান। এগুলো ধারাবাহিকভাবে থাকবে।
তার বাইরে কোন সুনির্দিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মুখপাত্র কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, তারা (কেএনএফ) আগের বিষয়গুলো তুলে ধরেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের ফেসবুকে পেইজে তারা যেগুলো দিয়েছে বলছে সেসব ব্যাপারে কথা বলেছে। কিন্তু আমরা তো এগুলো দেখি নাই। আমরা বলেছি তাদের দাবিগুলো লিখিত আকারে জমা দিতে। কারণ ডকুমেন্ট ছাড়া আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব না। আরো বলেছি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোন প্রস্তাবনা নিয়ে আমাদের সাথে সংলাপে বসা সম্ভব না।
‘তবে আমাদের মূল কাজ আস্থা অর্জন করা। তাদের সাথে সংলাপের প্রক্রিয়া চালিয়ে সমাধানের জন্য তাদের দাবিগুলো সরকারের কাছে তুলে ধরা।’
শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়, দ্বিতীয় দফা সংলাপে শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- বম সোশ্যাল কাউন্সিলের সভাপতি লালজারলম বম এবং সাধারণ সম্পাদক লালথাং জেল বম, ধর্মীয় গুরু পাকসিম বম, কৃপা ত্রিপুরা, খুমী সোশ্যাল কাউন্সিলের উপদেষ্টা লেলুং খুমী, অ্যাডভোকেট বাসিংথুয়াই মারমা, বাংলাদেশ মারমা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মংচিংনু মারমা, সাংবাদিক বুদ্ধজ্যেতি চাকমা ও উজ্জ্বল তঞ্চঙ্গ্যা।
অন্যদিকে কেএনএফের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মইয়া ওরফে লালজং সই বম, মেজর লিয়ানা ওরফে জেরসিং লিয়ান বম, কর্নেল ভাপুয়া ওরফে লালসাংলম বম এবং মেজর স্টে ওয়াড ওরফে লালসাং রেস বম।
২০২২ সালের শুরুর দিকে বান্দরবানের রুমা উপজেলায় কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামে একটি সশস্ত্র সংগঠনের কথা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে জানা যায়। বম, পাংখোয়া, লুসাই, খিয়াং, খুমি ও ম্রোদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে বলে দাবি করা হলেও সেখানে বম জনগোষ্ঠীর কিছুসংখ্যক লোকজন রয়েছে। যার কারণে সংগঠনটি পাহাড়ে ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিতি পায়।
কেএনএফের ফেসবুক পেইজে তারা জানায়, রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাইছড়ি বিলাইছড়ি ও বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি, লামা ও আলীকদমসহ নয়টি উপজেলা নিয়ে ‘কুকি-চিন রাজ্য’ হিসেবে গঠন করা হবে। পরবর্তীতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সশস্ত্র সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে আতঙ্কে সেই সময় ভারতের মিজোরামে পালিয়ে আশ্রয় নেয় পাঁচ শতাধিক বম নারী-পুরুষ।
স্বাভাবিক পরিস্থিতি ও স্থিতিশীল পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে ৩০ মে মাসে বান্দরবান জেলার বিভিন্ন জাতিসত্তার প্রতিনিধি নিয়ে তৈরি করা হয় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি। পরে জুন মাসে শেষ সপ্তাহে জেলা পরিষদের সভা কক্ষে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয় শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটির গঠন ও উদ্দেশ্য।
১৮ সদস্যের এই শান্তি প্রতিষ্ঠার কমিটি আহবায়ক হিসাবে রয়েছেন বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগরে সভাপতি ক্য শৈ হ্লা মারমা এবং সদস্য সচিব হিসাবে রয়েছে বম সোশ্যাল কাউন্সিলে সভাপতি লালজারলম বম। জেলা পরিষদের সদস্য কাঞ্চনজয় তঞ্চঙ্গ্যাকে কমিটির মুখপাত্র হিসাবে রাখা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বান্দরবান জেলায় কুকিচিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ); যা ‘বম পার্টি’ নামে পরিচিত এই সশস্ত্র সংগঠনটি অর্থের বিনিময়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ সদস্যদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে গত বছর অক্টোবর মাসে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে জানায় র্যাব।
এরপর গত বছর ১৭ অক্টোবর থেকে জঙ্গি ও কেএনএফ সদস্যদের বিরুদ্ধে রোয়াংছড়ি ও রুমা উপজেলার অভিযান চালায় র্যাব ও সেনা সদস্যের যৌথ বাহিনী। পরবর্তীতে এ অভিযান চালানো হয় থানচি উপজেলাতেও। ইতিমধ্যে অভিযান চালাতে গিয়ে নিহত হয়েছে সেনাবাহিনীর বেশ কিছু সদস্যও। সংঘাতে প্রাণ গেছে কেএএনএফ সদস্যেরও।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে কয়েক দফা ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার মেয়াদ বাড়িয়ে রোয়াংছড়ি, রুমা, থানচি ও আলীকদম উপজেলায় অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশী-বিদেশী পর্যটক ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। পরে পর্যায়ক্রমে তিন উপজেলা থেকে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা নেওয়া হলেও রোয়াংছড়ি উপজেলায় দেশী-বিদেশী পর্যটক ভ্রমণে এখনো নিষেধাজ্ঞা বহাল রয়েছে।