কক্সবাজার জেলা কারাগার
ধারণ ক্ষমতার চারগুণ বন্দী

তাহজীবুল আনাম, কক্সবাজার
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২০:২১

কক্সবাজার জেলা কারাগার
বন্দীদের সুশৃঙ্খল, মাদকমুক্ত ও উন্নত জীবন গড়তে কক্সবাজার জেলা কারাগার শক্ত অবস্থানে রয়েছে। আগেকার নানা অনিয়ম, অভিযোগ ও দুর্নীতির তকমা পিছনে ফেলে শতভাগ পরিচ্ছন্ন ও জবাবদিহিতামূলক সেবা নিশ্চিত করেছেন জেল সুপার মো. শাহ আলম খান। সেই সাথে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে কারারক্ষীরাও। কারাগারে ভেতরে - বাইরে নানা শৃঙ্খলা ও কঠোর নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। বন্দীদের সংশোধনের জন্য কারাবিধি অনুসারে তৎপর সংশ্লিষ্টরা।
২০০১ সালে উদ্বোধন হওয়া কক্সবাজার জেলা কারাগারে ৮৬৬ জন পুরুষ ও ৩৪ জন নারী বন্দী থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে কারাগারে প্রায় ৩ হাজার ২৭০ জন বন্দী রয়েছেন৷ যা ধারণ ক্ষমতার প্রায় ৪ গুণ বেশি। এর মধ্যে এখন নারী বন্দী রয়েছে ১৫৫ জন, শিশু ৩২ জন, এবং পুরুষ ৩ হাজার ৮৩ জন। এছাড়াও ৬ শতাধিক রোহিঙ্গাও রয়েছে। এদিকে অতিরিক্ত বন্দীদের চাপ সামলাতে হিমশিম খেতে হয় কারারক্ষীদেরও। তারপরও দায়িত্ববোধ ও কর্তব্যের জায়গা থেকে দিনরাত বন্দীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তারা।
‘রাখিব নিরাপদ, দেখাবো আলোর পথ’- এ শ্লোগানকে বুকে ধারণ করে তা পরিপূর্ণ করতে কারাগারের ভেতরে বাইরে কাজের গতি বাড়ানো হয়েছে। বন্দীদের জন্য বিধি মোতাবেক শতভাগ প্রাপ্য সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে। কারাগারে শান্তি-শৃঙ্খলা অটুট রাখতে কারা মনিটরিং বৃদ্ধি করা হয়েছে, অসুস্থ বন্দীদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা, ক্যান্টিনে ন্যায্যমূল্যে খাবারের ব্যবস্থা, সার্বক্ষণিক তদারকি, বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহ, মানসম্মত খাবার পরিবেশন, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা, সর্বোপরি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে কাজ করছেন কারা কর্তৃপক্ষ। এছাড়াও মাদক প্রতিরোধে কঠোর অবস্থানে কাজ করছেন কারা কর্তৃপক্ষ। কারাগারের ভিতর মাদক বিক্রেতারা যাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে এজন্য বেশ সতর্ক অবস্থানে কাজ করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বৃহস্পতিবার (৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে কারাগারের প্রধান ফটকে কথা হয় রামুর চাকমারকুল এলাকার সাব্বির আহমদের ছেলে আবদুর রহমানের সাথে। তিনি যৌতুক দাবি সংক্রান্ত একটি মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার পর কারাগারে হাজতি হিসেবে ছিলেন টানা ২০ দিন। বুধবার আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর কারাগার থেকে বের হন তিনি।
২০ দিনের কারা জীবন সম্পর্কে তিনি জানান, নিজের ঘরের মতোই পরিবেশ। কারাগার সম্পর্কে লোকমুখে যা শুনেছি, বাস্তবে তার মিল নেই। মোটামুটি ভালো পরিবেশে ছিলাম।
আবদুর রহমান আরো জানান, সেখানে একটি সুশৃঙ্খল এবং রুটিন মাফিক জীবন ছিল। মান সম্মত খাবার, সপ্তাহের একদিন ৮-১০ মিনিট মোবাইল ফোনে মিনিট প্রতি ১ টাকা করে পরিশোধ করে পরিবারের স্বজনদের সাথে আলাপ। ১৫ দিনের একবার স্বজনরা কারাগারে এসে সাক্ষাত। স্বজনদের দেওয়া পিসিতে জমা টাকা কার্ড প্রদর্শন করে কারাভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারা। সব মিলে ভালো সময় কেটেছে। এছাড়াও প্রতিদিন সুপার স্যার শাহ আলম সবকিছু দেখভাল করতেন। বন্দীদের সাথে মিষ্টি কণ্ঠে আন্তরিকতার সাথে কথা বলতেন। বন্দীদের সুবিধা অসুবিধা জানতে চাইতেন তিনি।
একই সময় কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হওয়া টেকনাফের উত্তর শীলখালী এলাকার মোস্তাক আহমদের ছেলে বাবুল (৩০)। তিনি মারামারি সংক্রান্ত মামলায় দেড় মাস বন্দি থাকার পর মঙ্গলবার বের হয়েছেন।
তিনি বলেন, কারাগারে বন্দীর থাকার জন্য ওয়ার্ড বণ্টন, চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণের ক্ষেত্রে পূর্বের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। কারাভ্যন্তরে বড় এলইডি পর্দায় শিক্ষা ও বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচারণার ফলে বন্দীদের মানসিক অবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে। আগে ক্যান্টিনে খাবারের মূল্য তালিকা ছিল না, এখন মূল্য তালিকা রয়েছে।
এভাবে কারাগার থেকে সদ্য বের হওয়া মহেশখালী, কুতুবদিয়া, উখিয়া, টেকনাফ ও চকরিয়ার বেশ কয়েকজন মানুষের সাথে কথা হয়েছে। সবাই রহমান ও বাবুলের ন্যায় একই তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কারাগার সূত্রে জানা গেছে, সম্পূর্ণ সুষ্ঠু, সুন্দর ও পরিকল্পিত নিয়মে চলছে কক্সবাজার জেলা কারাগার। এখানে নগদ টাকা লেনদেন একেবারে বন্ধ রয়েছে। বন্দীর কোন স্বজন পিসিতে রশিদ মূল্যে টাকা জমা দিলে সেই টাকা জমা হওয়ার পর বন্দির হাতে পৌঁছে যায় পিসি কার্ড। কার্ড ব্যবহার করে ক্যান্টিনে প্রদর্শিত মূল্য তালিকা দেখে মালামাল ক্রয় করতে পারেন বন্দীরা। এদিকে কারা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে কতিপয় একটি স্বার্থান্বেষী মহল বিভিন্ন সময় কক্সবাজার জেলা কারাগারের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলকভাবে অপপ্রচারে লিপ্ত রয়েছে। একটি চক্র কৌশলে সুবিধা আদায় করতে এ পন্থা বেছে নিয়েছে বলে অভিযোগ কারা কর্তৃপক্ষের।
কক্সবাজার জেলা কারাগারের সুপার মো. শাহ আলম খান জানিয়েছেন, ধারণ ক্ষমতার প্রায় ৪ গুণ বেশি বন্দী এবং অপ্রতুল জনবল নিয়েও সকলের সহযোগিতায় কারাগারের শৃঙ্খলা ফেরাতে আমরা কাজ করছি। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিআরসির সহযোগিতায় শিশুদের জন্য বিনোদনের কক্ষ ও বিনোদন সামগ্রী পাওয়া গেছে। এছাড়াও এসব শিশুদের লেখাপড়া, দুই বেলা দুধসহ পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। এর বাইরে সুপেয় পানির জন্য একই সংস্থার অধীনে কারাভ্যন্তরে প্রকল্পের কাজও চলমান রয়েছে।
তিনি জানান, আমি নিয়মিত কারাগার পরিদর্শনের মাধ্যমে বন্দীদের সাথে আলাপ করে যেকোনো সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিয়ে থাকি। নিয়মিত খাবারের সঠিক মান নিশ্চিত ও ওজন পর্যবেক্ষণ করে বন্দীদের সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়।
এছাড়াও মোবাইল ফোনে আলাপ ও স্বজনদের সাক্ষাতে স্বচ্ছতার সাথে করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। জামিন খালাসে মুক্তি প্রদানের যেকোনো হয়রানি রোধে প্রতিদিন জামিনপ্রাপ্ত বন্দীদের নাম কারা ফটকের সামনে এলইডি ডিসপ্লের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। ফলে জামিন নিয়ে এক শ্রেণির প্রতারক চক্রের অপতৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে। যারা সাক্ষাতের জন্য কারাগারে আসেন তাদের বিনোদনের জন্য গেইটের পাশে দর্শনার্থী বিশ্রামাগারে বড় টেলিভিশন ও ক্যান্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বন্দীদের সকল কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে আমি আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি।
অন্যদিকে, ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত বন্দী হওয়ায় একটি উন্মুক্ত কারাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। বন বিভাগের নানা ছলচাতুরী ও তালবাহানায় উন্মুক্ত কারাগার নির্মাণ থমকে গেছে বলে জানান জেল সুপার।