বান্দরবনে খেয়াং বর্ণমালার কী-বোর্ড উদ্বোধন

বান্দরবন প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৫৫

খেয়াং বর্ণমালার কী-বোর্ড উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ছবি: বান্দরবন প্রতিনিধি
বান্দরবনে খেয়াং জনগোষ্ঠীর বর্ণমালা কম্পিউটার কী-বোর্ড স্থাপন অনুষ্ঠান উদ্বোধন করা হয়েছে। ফ্রেন্ডস অব এনডেঞ্জারড এথনিক ল্যাংগুয়েজস (ফিল) নামে ভাষা গবেষকদের একটি দল খেয়াং বর্ণমালাটি কম্পিউটার কী-বোর্ডে স্থাপন করা হয়।
গতকাল শনিবার (২৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বান্দরবন সদর উপজেলার কুহালং ইউনিয়নের গুংগুরুমুখ খেয়াং কমিউনিটি সেন্টারে এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
শিক্ষক ও সমাজকর্মী অংসাউ খেয়াং এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বান্দরবন পার্বত্য জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য ম্রাসা খেয়াং। অন্যান্যদের মধ্যে ভাষা গবেষক মৃদুল সাংমা, ভাষা প্রযুক্তিবিদ সমর মাইকেল সরেন, ভাষা গবেষক রিবেং দেওয়ান, শিক্ষিকা হ্লা ক্রই প্রু খেয়াং ও শিক্ষক চিংহ্লা উ খেয়াং উপস্থিত ছিলেন।
অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, বিংশ শতাব্দীর উন্নত প্রযুক্তিতে নিজেদের মাতৃভাষা লিখিত রুপে মনের ভাব বিনিময় করতে পারা সত্যিই গর্বের বিষয়। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই ভাষাটি কম্পিউটার কী-বোর্ডে যুক্ত করার উপযোগী করা হয়েছে তাদেরকে অনাদি কাল ধরে স্মরণ রাখবে খেয়াং জনগোষ্ঠীর লোকজন।
ফ্রেন্ডস অব এনডেঞ্জারড এথনিক ল্যাংগুয়েজস (ফিল) সংস্থার তত্বাবধানে প্রায় ২ মাসের প্রচেষ্টায় এই ভাষার বর্ণমালা কম্পিউটার কী-বোর্ডে যুক্ত করতে সক্ষম হন। ভবিষ্যতে মোবাইল কী-বোর্ডে ব্যবহারের উপযোগী অ্যাপস তৈরি করা হবে। যার মাধ্যমে মোবাইলে খেয়াং ভাষার বর্ণমালা ব্যবহার করে তথ্য আদান প্রদান করতে পারবেন এই জনগোষ্ঠীর লোকেরা।
ফ্রেন্ডস অব এন্ডেঞ্জার্ড এথনিক ল্যাংগুয়েজস (ফিল) Frends of endangered ethnic Languages (FEEL) সংস্থার ভাষা গবেষক রিবেং দেওয়ান বলেন, দুই থেকে আড়াই বছর আগে দেশে বিপন্ন প্রায় যে ভাষা রয়েছে সে ভাষাগুলোকে ডিজিটালাইজ করার লক্ষ্য নিয়ে যাত্রা শুরু করে সংস্থাটি। এই পর্যন্ত ১৬টি বিপন্ন ভাষাকে কম্পিউটার কী-বোর্ড তৈরিতে সক্ষম হয়েছেন তারা।
ভাষা প্রযুক্তিবিদ সমর মাইকেল সরেনন বলেন, সংস্থার ৭ জন সদস্যের প্রচেষ্টায় খেয়াং ভাষায় উদ্ভাবিত কী-বোর্ডটি দেশে এবং এশিয়া মহাদেশে নবীনতম ডিজিটালাইজ ভাষায় যুক্ত হল। যা পৃথিবীর লিখিত ডিজিটালাইজ ভাষার মধ্যে ২৯৪ তম কী-বোর্ড ভাষায় স্থান পেয়েছে। এই ভাষার প্রচলন ও চর্চা বাড়াতে খেয়াং ভাষায় কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও রুপকথার গল্প খেয়াং বর্ণমালায় লেখা দরকার।
এছাড়া পাহাড়িয়া, চাকমা, ম্রো, গারো, কোল, মুন্ডা, সান্তাল, খুমী, ও খাড়িয়া, ওরাও সম্প্রদায়ের ভাষা রিসোর্স ও রাইটিং টুলস, ভাষা অভিধানের প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।
খেয়াং ভাষা বর্ণ মালার উদ্ভাবনের অন্যতম সদস্য ঞো জাই উ খেয়াং বলেন, নিজেদের ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও মূল্যবোধের সহায়ক বর্ণমালা উদ্ভাবন করার পর ২০১৭সালে ২২শে অক্টোবর খেয়াং ভাষা ও বর্ণমালা বইয়ের প্রকাশনা উৎসব পালন করা হয়েছে। খেয়াং ভাষার বর্ণমালার মধ্যে স্বর বর্ণ ১১টি আর ব্যঞ্জন বর্ণ ২১টি, উদ্ভাবিত খেয়াং ভাষার সাথে উচ্চারণ, ধ্বনি সবকিছুই ঠিক আছে এবং শেখা খুবই সহজ। এলাকার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে খেয়াং ভাষা শেখানো হয়েছিলো। আর্থিক সংকটের কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। রোমান হরফে বর্ণমালায় খেয়াং ভাষার উচ্চারণ ও ধ্বনির কিছুই মিল নেই। রোমান হরফ দিয়ে লেখা ও ভাষা চর্চা করা হলে খেয়াং জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি মূল্যবোধ সব হারিয়ে যাওয়ার আশংকা রয়েছে।
এদিকে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের নৃভাষা বৈজ্ঞানিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ১৫টি ভাষা বিপন্ন ভাষার তালিকায় রয়েছে। তার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৫টি বিপন্ন ভাষার মধ্যে খেয়াং ভাষা একটি।
খেয়াং সামাজিক নেতারা বলেছেন, তাদের মধ্যে লাইতু ও কুনতু নামে দুই সম্প্রদায় খেয়াং রয়েছে। লাইতু খেয়াংদের বসবাস সমতলের অংশে। পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারীদের কুনতু খেয়াং বলা হয়। এ ক্ষেত্রে লাইতু খেয়াংরা বৌদ্ধধর্মাবলম্বী, অপর দিকে খ্রিষ্টানধর্মাবলম্বীরা হলেন কুনতু খেয়াং। বিভিন্ন সময় নিজেদের করা জরিপে বান্দরবন ও রাঙ্গামাটি দুই জেলা মিলে সর্বমোট পাঁচ থেকে সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো খেয়াং রয়েছে বলে মনে করেন তারা।