অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে হাছন রাজার জন্মভিটা

লতিফুর রহমান উজ্জল, সিলেট
প্রকাশ: ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ১০:০২

হাছন রাজার জন্মভিটা।
‘মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে, কান্দে হাছন রাজার মন ময়নারে’ পৃথিবীর মায়ার মোহে আটকে কেঁদে কেঁদে এমনই অনেক কালজয়ী গান সৃষ্টি করেছেন মরমি কবি সাধক হাছন রাজা। হাছন রাজার জন্ম ১৮৫৪ সালের ২১ ডিসেম্বর। তার পিতার নাম দেওয়ান আলী রাজা চৌধুরী। হাছন ছিলেন তার তৃতীয় পুত্র। সিলেট বিশ্বনাথের সেই রামপাশা গ্রামে হাছনের জন্মভিটায় ধ্বংসাবশেষ ছাড়া তেমন কোনো স্মৃতি নেই। চোখে পড়েনি তার ছবি কিংবা একটি গানের লিপি। যে বাড়িতে বসে হাছন রাজা জমিদারি করেছেন, রচনা করেছিলেন শত শত কালজয়ী গান আজ যেন তার গানের মতোই বিলাপ করছে হাছনের জন্মভিটা। স্মৃতিচিহ্নের অভাবে যেন কাঁদছে তার যৌবন-বৃদ্ধে কাটানো রামপাশার বাড়ি।
সরেজমিনে হাছন রাজার জন্মভিটা রামপাশা ঘুরে তার গানের কথার মতোই এমন চিত্রই চোখে পড়েছে। চোখে পড়েছে হাছনের থাকার ঘর, যা রামপাশা পোস্ট অফিস হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তবে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় এখন পরিত্যক্ত। তবুও হাছনের স্মৃতির খোঁজে রামপাশায় ছুটে যান অনেক হাছনপ্রেমিক।
হাছন রাজার বংশধররা ছিলেন হিন্দু। ষোড়শ শতকের শেষ দিকে তাদের এক পূর্বপুরুষ সিলেটে এসে বসতি স্থাপন করেন। তাদের এক পূর্বপুরুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। তার নাম বাবু খাঁ চৌধুরী, যিনি হাছন রাজার দাদা। হাছন রাজার পূর্বপুরুষরা ছিল অযোধ্যায়। হাছন রাজার ভক্ত ছাড়াও দেশি-বিদেশি গবেষকরা প্রায়ই এখানে আসেন বলে জানা যায়।
মাত্র ১৫ বছর বয়সে জমিদারি শুরু করেন হাছন রাজা। অপরিপক্ব বয়সে এত সম্পদের মালিক হয়ে হাছন রাজা বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। যৌবনে তিনি ছিলেন ভোগ-বিলাসী এক শৌখিন জমিদার। ৫ লাখ ২০ হাজার বিঘা জমির মালিক ছিলেন হাছন রাজা। এখনো সিলেটের কোম্পানীগঞ্জ, বিশ্বনাথ, সুনামগঞ্জ, লক্ষণছিড়িসহ বিভিন্ন এলাকায় এসব জায়গা বা সম্পত্তি রয়েছে।
বর্ষায় বজরা নৌকা সাজিয়ে গান-বাজনায় ঘুরে বেড়াতেন হাছন রাজা। এ সময় একের পর এক গান লিখতেন। বিলাসী জীবনের মাঝে আধ্যাত্মিক বোধের জন্ম নেয় হাছন রাজার মনে। ছেড়ে দেন জমিদারি। বিলাসী পোশাক ছেড়ে নেন সাধারণ পোশাক। অত্যাচারী জমিদার থেকে হয়ে ওঠেন এক বাউল সাধক। রামপাশা ছিল হাছন রাজার পৈতৃক ভিটা। এখানে তার বাবা, দাদার জন্ম হয়েছে। সুনামগঞ্জ ছিল তার হালগড়া (জমিদারি)। সেখানেও থাকতেন হাছন রাজা।
হাছন রাজার মৃত্যু হয় ১৯২২ সালে সুনামগঞ্জে। তখন ছিল শুষ্ক, রামপাশায় নৌকা আসে না। গাড়ি-ঘোড়ার ব্যবস্থাও ছিল না। নৌকার সময় না থাকায় সুনামগঞ্জে একটি এলাকাধীন কবরস্থানে তাকে সমাধি দেওয়া হয়।
সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলা শহর থেকে পশ্চিম-উত্তরে রামপাশা বাজারের ঠিক আগেই হাছন রাজার জন্মভিটার অবস্থান। পুকুর, শান বাঁধানো ঘাট, ঘাটে শতবছরের পুরনো পাথর। অন্দরমহলের জন্য বাড়ির উঠোনে তৈরি প্রাচীন দেয়াল। যা লতাগুল্মে ছেয়ে গেছে। বাড়ির ভেতরে বাইরের কোনো পুরুষ আসতে পারত না। তাই মাঝে দেয়াল তৈরি করা হয়। এই দেয়াল সাড়ে তিনশ বছর আগের তৈরি।