আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনের ৭২টিতে প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। বাকি ২২৮ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত হচ্ছে শনিবারের মধ্যেই। এজন্য শুক্রবার সকালে বরিশাল বিভাগের মনোনয়ন চূড়ান্ত করতে সভা করেছে আওয়ামী লীগের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ড।

সূত্র বলছে, শুক্রবার সকালে অনুষ্ঠিত সভায় বিভাগের ২১টি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী চূড়ান্ত করেছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামীকাল রবিবার সকল আসনের প্রার্থীদের তালিকা এক সঙ্গে প্রকাশ করবে দলটি।

তবে তার আগেই গোটা দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে চলছে গুঞ্জন। বলা হচ্ছে, বিভাগের ২১টি আসনের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে নৌকার মাঝি চূড়ান্ত হয়েছে নতুন মুখ। আবার অনেক আসনে বর্তমান সংসদ সদস্যরাই থেকে যাচ্ছেন। এখন শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণার অপেক্ষা।

যদিও মনোনয়ন ঘোষণার আগে এ নিয়ে কথা বলতে নারাজ আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা। তারা বলছেন, এটা নেত্রীর (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) গোপনীয় সিদ্ধান্ত। তাই মনোনয়নের চিঠি হাতে না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গুঞ্জনের শুরুটা মূলত মনোনয়ন আবেদন ফরম জমা দেওয়ার দিন থেকেই। তবে সেই গুঞ্জন আর বিস্তরভাবে ছড়িয়েছে শুক্রবার মনোনয়ন বোর্ডের সভা শেষে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, রাজনৈতিক আলোচনা এবং চায়ের দোকানের আড্ডায় উঠে আসছে সম্ভাব্য চূড়ান্ত প্রার্থীদের নাম।

এর মধ্যে বরিশাল জেলার ৬টি আসনে প্রার্থী নিয়েই গুঞ্জনে সরব নগরীসহ গোটা জেলা। ছয়টি আসনের তিনটিতেই পরিবর্তন আসছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। তবে দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, এ ছয়টি আসনের পাঁচটিতে প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়টি নির্ভর করছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। জনমত জরিপের মাধ্যমে প্রার্থী ঘোষণা করবেন তিনি।

তবে নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির জ্যেষ্ঠ সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর মনোনয়ন আগে থেকেই চূড়ান্ত হয়ে আছে। এই আসনে তিনি একই মনোনয়ন আবেদন ফরম জমা দিয়েছেন।

অপরদিকে, বরিশাল-২ (উজিরপুর-বানারীপাড়া) আসনে আসছে নতুন মুখ। সংসদ সদস্য থাকাবস্থায় নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি স্বাধীনতা বিরোধী পরিবারের সন্তান হওয়ায় এবারের মনোনয়ন দৌড়ে হয়তো ছিটকে পড়ছেন শাহে আলম। তার আসনটিতে মনোনয়ন পাচ্ছেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য তালুকদার মো. ইউনুস।

তবে আলোচনায় থাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, গুঞ্জন শুনছি; তবে এটি একান্তই নেত্রীর সিদ্ধান্ত। তাই মনোনয়নের চিঠি হাতে পাওয়ার আগে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

অপরদিকে, বর্তমান সরকারের গত তিনটি আমলেই বরিশাল-৩ (মুলাদী-বাবুগঞ্জ) আসনটি মহাজোটের সরিক দল জাতীয় পার্টি অথবা ওয়ার্কার্স পার্টিকে ছাড় দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এ কারণে ইতোপূর্বে সংসদ নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেলেও দলীয় প্রার্থী পাননি মুলাদী-বাবুগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ।

তবে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আসনটিতে নিজ দল থেকেই প্রার্থী দেওয়ার গুঞ্জন চলছে। সেই গুঞ্জনে এখন পর্যন্ত উঠে আসছে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান সরদার খালেদ হোসেন স্বপনের নামটি। তিনিই এই আসনে শেষ পর্যন্ত নৌকার মাঝি হবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।

অপরদিকে জেলার মধ্যে অন্যতম বরিশাল-৪ (হিজলা-মেহেন্দিগঞ্জ) আসনটি। এই আসনটির বর্তমান সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথের সাথে জেলা এবং স্থানীয় আওয়ামী লীগের বৃহৎ একটি অংশের বিরোধ দীর্ঘ দিনের। তাছাড়া বিভিন্ন সময় স্থানীয় পর্যায়ে নানা আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুও হন পংকজ নাথ। এ জন্য প্রথমে স্বেচ্ছাসেবক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং পরে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টার পদ হারান তিনি।

এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন থেকেও বাদ যাচ্ছেন বলে আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। বলা হচ্ছে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে ক্ষমতার মসনদে থাকা পংকজ নাথকে বাদ দিয়ে মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদকে। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি এবং সংসদ সদস্য ছিলেন।

এ প্রসঙ্গে বরিশাল-৪ আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ও মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট আফজালুল করিম বলেন, যে গুঞ্জন চলছে সত্যি বলে মনে হচ্ছে না। ফেসবুক এবং বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালে নানা ধরনের তথ্য পাচ্ছি। তবে এসবের কোনো নির্ভরযোগ্য ভিত্তি নেই। কারণ এসব ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তাছাড়া শুনেছি প্রধানমন্ত্রী নিজেই বরিশালের ছয়টি আসনের সিদ্ধান্ত দিবেন।

এদিকে বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ মর্যাদার আসন বরিশাল সদর-৫ আসনটি। বরিশাল সিটি ও সদর উপজেলা নিয়ে গঠিত এই আসনটি বিএনপির ঘাটি হিসেবে পরিচিত। তবে গত ১০ বছর ধরে এই আসনটিতে সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের। আর তাই বিএনপির দুর্গ এখন আওয়ামী লীগের ঘাঁটি বলে দাবি করছেন স্থানীয় নেতারা।

যদিও আসন্ন নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের বিষয়টি এখনো অনিশ্চিত। তার পরও মর্যাদার এই আসনটিতে শক্ত প্রার্থী দিচ্ছে আওয়ামী লীগ। সেই হিসেবে বর্তমান সংসদ সদস্য জাহিদ ফারুক শামীম ও সাবেক সিটি মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহই রয়েছেন আলোচনায়।

অবশ্য গত দুদিন ধরে চলা গুঞ্জনে জাহিদ ফারুক শামীমের নামটি উঠে আসছে সবার আগে। তার অনুসারীরা দাবি করছেন, সদর আসনে জাহিদ ফারুক শামীমের মনোনয়ন নিশ্চিত। তিনিই আসনটিতে পুনরায় নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

তবে উল্টোটা শোনা যাচ্ছে সাদিক আবদুল্লাহ অনুসারীদের কাছ থেকে। তাদের দাবি সিটি নির্বাচনে মনোনয়ন বঞ্চিত সাদিক আবদুল্লাহকে সদর আসনে মনোনয়ন দিবেন দলের সভানেত্রী। তার মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়ে আছে। তাছাড়া সাদিক আবদুল্লাহর বাবা আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য। তাই ছেলে সাদিক আবদুল্লাহর মনোনয়ন নিশ্চিত করতে বাবাই বড় ভূমিকা রাখছেন।

যদিও আওয়ামী লীগের অপর একটি সূত্র বলছে ভিন্ন কথা। সূত্রটি বলছে সদর আসনে প্রার্থী পরিবর্তন চান খোদ দলের সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ কারণেই তিনি নিজেই আসনটিতে আওয়ামী লীগ নেতা মাহাবুব উদ্দিন আহমেদ-বীর বিক্রমের নাম প্রস্তাব করেন। তখন জাহিদ ফারুক শামীম ও সাদিক আবদুল্লাহর নাম প্রস্তাব করেন মনোনয়ন বোর্ডের অপর চার সদস্য।

অপরদিকে জাতীয় পার্টির দখলে থাকা বরিশাল-৬ আসনেও আওয়ামী লীগের প্রার্থী চূড়ান্ত বলে শোনা যাচ্ছে। আসনটিতে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মেজর (অব.) আব্দুল হাফিজ মল্লিক মনোনয়ন পেয়েছেন। এখন শুধু ঘোষণার অপেক্ষা মাত্র। রবিবার মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সাথে সভা শেষে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করবেন।

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন বলেন, বিষয়টি একাবারেই গোপনীয়। কে কোথা থেকে কী মন্তব্য করছে, সেটা কোন বিষয় নয়। এটা একান্তই নেত্রীর সিদ্ধান্ত। আগামী রবিবার মনোনয়ন ঘোষণার পরেই বিষয়টি পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে যাবে।