ভোজন প্রিয় বাঙালির শীত মানেই পিঠা খাওয়ার মৌসুম। অগ্রহায়ণের নতুন ধানের চালের পিঠা না খেলে অসম্পূর্ণ থাকে বাঙালিয়ানা। একসময় শহর বা গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি হতো ভাপা, পুলি, চিতই ও তেলের পিঠাসহ বাহারি এবং নানা স্বাদের পিঠা। বাড়ি বাড়ি ধূম পড়তো পিঠা খাওয়া। 

তবে সম্প্রতি আধুনিক ইন্টারনেটের যুগে ইউটিউব থেকে বাড়ির মা-বোনেরা নানা রেসিপি দেখে রেসিপি তৈরিতে ঝুঁকে পড়েছে। ফলে দেশীয় সব পিঠা এখন আর বাসা বাড়িতে খুব একটা তৈরি হয় না। তবে এসব পিঠার কদর এখন ফুটপাতের দোকানগুলোতে দেখা যাচ্ছে। প্রতিবছর শীত মৌসুমে শেরপুর জেলা শহরের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে এসব পিঠার দোকান লক্ষ্য করা যায়। শুধু শহরের মোড়েই নয় শহরের বিভিন্ন পাড়া-মহল্লাতেও একশ্রেণির মানুষ এসব পিঠা তৈরি করে বাড়তি আয় করছে। এসব পিঠার দোকানে ভিড় করে শহরের বিভিন্ন প্রান্তের নারী-পুরুষসহ নানা বয়স এবং নানা পেশার মানুষ।

সরেজমিনে শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, শীত এলেই শেরপুরের একশ্রেণীর মৌসুমী ব্যবসায়ী শীতের নানান পিঠার দোকান দিয়ে বসেন। এসব দোকান শহরের প্রধান প্রধান মোড়ে বসেন। প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ১০ টা পর্যন্ত এবং বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত শীতের ভাপা পুলি, চিতই এবং স্থানীয় ভাষায় গোটা বা মুঠো পিঠা তৈরি করে বিক্রি করা হয়। এসব পিঠার দোকানে মাঝেমধ্যে এতো ভিড় হয় যে অনেকেই দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করে পিঠা খেয়ে থাকেন এবং বাড়ির জন্য নিয়ে যান। 

জানা গেছে, বাসা-বাড়িতে পিঠা বানানোর নানা ঝামেলার কারণে শহরের অনেক অভিজাত পরিবারের মানুষও এসব পিঠার দোকানে এসে গরম গরম পিঠা দাঁড়িয়ে থেকে খেয়ে এবং বাড়ির জন্য নিয়ে যান। এছাড়া সকালবেলা অনেক ছিন্নমূল এবং শ্রমজীবী মানুষ এসব পিঠা খেয়ে সকালের নাস্তার কাজ সারেন। এসব পিঠার মধ্যে ভাপা ও চিতই ১০ টাকায়, তেলের পিঠা এবং স্থানীয় ভাষায় মুঠো বা গোডা বা গরগরি পিঠা ৫ ও ১০ টাকা মূল্যে বিক্রি হয়। চিতই পিঠার সাথে দেওয়া হয় শুটকি ভর্তা, সরিষা বাটা ও ধনেপাতার ভর্তা। আর মুঠো পিঠায় বেগুন ভর্তা দেয়া হয়। তবে শহরের বিভিন্ন প্রান্তে এসব পিঠার দোকান বসলেও সন্ধ্যার পর শহরের খরমপুর মোড়ের পিঠার দোকানে সবচেয়ে বেশি ভিড় দেখা যায়। 

এসব মৌসুমী পিঠা ব্যবসায়ীরা শীতের ঠিক আগ থেকে শুরু করে এবং শীতের শেষ পর্যন্ত তাদের ব্যবসা চালিয়ে যান। এতে তারা শীত মৌসুমে বাড়তি আয় করে থাকেন বলে জানান স্থানীয় পিঠা ব্যবসায়ীরা।

এ বিষয়ে খরমপুর মোড়ের ভাপা পিঠা ব্যবসায়ী হাতেম আলি জানান, প্রতিদিন ভোর থেকে সকাল ১০ টা পর্যন্ত এবং আবার বিকেল থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত পিঠা বিক্রি করি। প্রতিদিন ১৫/১৬ কেজি চালের পিঠা বিক্রি করা হয়। এতে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত আয় হয় এবং এতে আমার সংসার ভালো ভাবেই চলে যায়।

একই এলাকার চিতই পিঠা ব্যবসায়ী নিলু মিয়া জানায়, প্রতিদিন বিকেল থেকে রাত ১১ টা পর্যন্ত প্রায় ১৫ কেজি চালের পিঠা বিক্রি করে থাকি। এতে প্রায় হাজার খানিক টাকা আয় হয় আমার।

অপর পিঠা ব্যবসায়ী সুজন মিয়া জানায়, আমার এখানে পুলি ও গোটা পিঠা বিক্রি করে প্রতিদিন ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকার মতো আয় হয়। আমার এখানে পিঠার সাথে নানা রকম ভর্তা দেওয়া হয়।

এসব দোকানে পিঠা খেতে আসা ক্রেতারা জানায়, বাড়িতে পিঠা বানানোর ঝামেলার কারণে আমরা এই ফুটপাতে পিঠা খেতে আসি মাঝেমধ্যে অবশ্য বাড়ির জন্যও নেয়া হয়। এসব পিঠা ফুটপাতে বিক্রি হলেও গুণগতমান ভালো এবং গরম গরম খাওয়ার কারণে অনেক স্বাদ হয়। অনেক সময় বাড়িতে মেহমান আসলেই এই পিঠা দিয়ে তাদেরকে আপ্যায়ন করা হয় বলে জানালেন শহরের কাজী মাসুম নামে এক ব্যবসায়ী।

ঝিনাইগাতে উপজেলার শিখা গোস্বামী নামে এক নারী নেত্রী জানায়, টং দোকানে বসে চা খাওয়ার যেমন মজা, তেমন ফুটপাতের পাশে দাঁড়িয়ে গরম গরম পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা। তিনি আরো জানায়, এক সময় ছোট বেলায় দেখতাম আমাদের মায়েরা, নানিরা উঠোনের মাটির চুলায় রাত জেগে নানা রকম পিঠা তৈরি করতো এবং উঠানে বসে পরিবারের সবাইকে নিয়ে মজা করে খেতাম। এখন সে অবস্থা আর নেই। এছাড়া আমরাও আধুনিক যুগে প্রবেশ করার কারণে আমরা এখন সেসব ভুলে গেছি। তাই ফুটপাতের পিঠার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি।

শীতের এসব পিঠা তৈরি করে বিক্রি করে পিঠা ব্যবসায়ীদের বাড়তি আয় এর পাশাপাশি যারা নানা কারণে বাসায় পিঠা তৈরি করে খেতে পারেন না তাদের জন্য শীতের পিঠা খাওয়ার সহজ পথ হয়েছে। সেই সাথে বাঙালির ঐতিহ্যকেও ধরে রেখেছে এসব মৌসুমী পিঠা ব্যবসায়ী।