জিকে সেচ প্রকল্প বন্ধ
গঙ্গা-কপোতাক্ষের খাল শুকিয়ে মাঠ, পানির অভাবে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির

এসএম জামাল, কুষ্টিয়া
প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪, ১২:৫৩

খালে স্থানীয়রা ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন। ছবি: কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত দেশের বৃহৎ গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের পাম্প ৩ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। জিকে সেচ প্রকল্পের পাম্প বন্ধ থাকায় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪ জেলার প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমি ফসল উৎপাদন থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। পানির অভাবে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির। চাষিরা যেমন দিশেহারা তেমনি এ এলাকার জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের সম্মুখীন। জিকে খালে পানি না থাকা এবং বৃষ্টি না হওয়ায় কুষ্টিয়া জেলায় ১ লাখেরও অধিক টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়েছে। সুপেয় পানির অভাবে মানুষ দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে।
এদিকে জিকের প্রধান খালে পানি না থাকায় ভেড়ামারার ৩ নং ব্রিজসংলগ্ন খালসহ বিভিন্ন এলাকায় স্থানীয়রা ক্রিকেট ম্যাচের আয়োজন করেছে।
১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লিতে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি ভাগাভাগি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী এইচ ডি দেবেগৗড়া ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই ঐতিহাসিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির শর্তানুযায়ী প্রতিবছর পানি দেওয়ার কথা, সেই চুক্তি অনুযায়ী ভারত বাংলাদেশকে পানি না দেওয়ায় সৃষ্টি হচ্ছে পানি সংকট- বলে মনে করেন পানি বিশেষজ্ঞরা।
১৯৬২ সালে এই প্রকল্পের মাধ্যমে পদ্মা নদী থেকে ইনটেক চ্যানেলের মাধ্যমে পানি এনে পাম্প করে সরবরাহ খালের মাধ্যমে কুষ্টিয়াসহ ৪ জেলার ১৩টি উপজেলায় জমিতে পানি সরবরাহ করা শুরু হয়। শুরুতে বছরের ১০ মাস (১৫ জানুয়ারি থেকে ১৫ অক্টোবর) দিনরাত ২৪ ঘণ্টা ৩টি পাম্পের মাধ্যমে পানি তোলা হতো। বাকি দুই মাস চলত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের কাজ। ১৯৩ কিলোমিটার প্রধান খাল, ৪৬৭ কিলোমিটার শাখা খাল ও ৯৯৫ কিলোমিটার প্রশাখা খালের মাধ্যমে সেচ প্রকল্পের পানি কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ ও মাগুরা জেলার কৃষকদের সেচ দেওয়ার এ কার্যক্রম শুরু হয়। শুরুতে কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, চুয়াডাঙ্গা ও মাগুরা জেলার ১ লাখ ৯৭ হাজার হেক্টর জমিতে সেচের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। নব্বইয়ের দশকে ১ লাখ ৬ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব হয়। বিঘাপ্রতি কৃষকেরা মাত্র ২০০ টাকার বিনিময়ে সেচ প্রকল্পের (জিকে) মাধ্যমে তারা পানি পেতেন। সেচ প্রকল্পের (জিকে) মাধ্যমে পানি না পাওয়ায় বর্তমানে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে সেচবাবদ প্রতি বিঘায় খরচ পড়ছে প্রায় ৭ হাজার টাকা। স্বল্প খরচের সেচব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন ৩৫ গুণ বেশি খরচ করে শ্যালো মেশিনের সাহায্যে ধানের জমিতে সেচ দিচ্ছেন কৃষকরা। কতদিন পর থেকে আবার ধানের জমিতে সেচ প্রকল্পের পানি পাবেন তার কোনো সঠিক তথ্য দিতে পারছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
জি-কে সেচ প্রকল্পের আওতায় শুরুতে তিনটি প্রধান পাম্প ও ১২টি সাবসিডিয়ারি পাম্পের সাহায্যে খালে পানি দেওয়া হতো। এ বছর ৩১ জানুয়ারিতে পাম্প চালু করে পানি ছাড়া হয়। কিন্তু ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে সর্বশেষ সচল পাম্পটিও ইলেকট্রিক্যাল সার্কিট নষ্ট হওয়ায় বন্ধ হয়ে যায়। তাতে কুষ্টিয়া সদর, মিরপুর, চুয়াডাঙ্গা সদর ও আলমডাঙ্গাসহ এই চার উপজেলার কৃষকরা চরম দুর্ভোগে পড়েন। পানির অভাবে অনেক কৃষক ধান লাগাতে পারেননি। কারও কারও ধানের জমি শুকিয়ে চৌচির হয়ে গেছে। আবার কেউ কেউ শ্যালো ইঞ্জিন দিয়ে বিকল্প সেচের ব্যবস্থা করেছেন কিন্তু তাতেও আশানুরূপ সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না।
সেচ প্রকল্পের দুটি মেশিন আগে থেকে নষ্ট থাকায় চলতি বোরো মৌসুমে ১টি পাম্প দিয়ে প্রকল্পের আওতায় সর্বোচ্চ ৯৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়া সম্ভব ছিল। কিন্তু শেষ পাম্পটি নষ্ট হওয়ায় এবার সেই লক্ষ্যমাত্রাও পূরণ হয়নি। তবে গত এপ্রিল মাসে ১নং পাম্পটি জাপানের ইবারা করপোরেশনের প্রকৌশলীদের সহযোগিতায় কারিগরি ত্রুটি মুক্ত করে সচল করা হলেও পদ্মানদীতে পানি স্বল্পতার কারণে পাম্প চালু করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সেচ প্রকল্পের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, পাম্প চালুর জন্য সেচ প্রকল্পের ইনটেক চ্যানেলে কমপক্ষে ১৪ ফুট উচ্চতায় পানি থাকা প্রয়োজন। কিন্তু পদ্মা নদীর পানি কমে যাওয়ায় ইনটেক চ্যানেলে পানির স্তর এখন মাত্র ১১ ফুট। ফলে পাম্প চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ৪ জেলার প্রায় ১ লাখ হেক্টর জমি ফসল উৎপাদন থেকে হচ্ছে বঞ্চিত। এতে কয়েক হাজার টন খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। পানির অভাবে ফসলের মাঠ ফেটে চৌচির। চাষিরা যেমন দিশেহারা তেমন এ এলাকার জীববৈচিত্র ধ্বংসের সম্মুখীন। জিকে খালে পানি না থাকা এবং বৃষ্টি না হওয়ায় কুষ্টিয়া জেলার ১ লাখেরও অধিক টিউবওয়েল অকেজো হয়ে পড়েছে। সু-পেয় পানির অভাবে এ অঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ দুর্বিসহ জীবনযাপন করছে। গৃহস্থালি কাজ ও গবাদি পশু পালনে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এ অঞ্চলের অনেক কৃষক মাঠে গভীর নলকূপ বসিয়ে শ্যালো মেশিনের মাধ্যমে ধানের ফসলে সেচ দিলেও বৃষ্টি না হওয়ায় ধানচাষ হচ্ছে ব্যাহত। ধানের শীষ শুকিয়ে হয়ে যাচ্ছে চিটে।
গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) কৃষক সমিতির সভাপতি আলাউদ্দিন বলেন, ‘এ বছর আমরা এখনো পানি পাইনি। এই মৌসুমে পানি পাওয়া যাবে না এমন তথ্য পাওয়া গেছে। আমরা এখন শ্যালো মেশিনের পানি দিয়ে ধান রোপণ করছি। এভাবে এক বিঘা জমি চাষ করতে প্রায় ৭ হাজার টাকা বেশি ব্যয় হচ্ছে। এতে চলতি বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন ব্যয় অনেক বাড়বে। বাড়তি খরচের আশঙ্কায় অনেক কৃষক ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন।’
কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘সেচ প্রকল্পের প্রধান এবং শাখা খালে পানি থাকলে সেচের পাশাপাশি আশপাশের নলকূপ ও পুকুরে পানি স্বাভাবিক থাকে। সেচ খালে পানি না থাকায় নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। বোরো ধানে সবচেয়ে বেশি সেচ দিতে হয়। ক্ষেত প্রস্তুত থেকে শুরু করে দানা আসা পর্যন্ত সেচ লাগে। কখনো দিনে দুইবারও সেচ দিতে হয়। পানি সরবরাহ শুরু ১৯ দিনের মাথায় হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিশাহারা হয়ে পড়েন কৃষকরা।’
ভেড়ামারা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহমুদা সুলতানা জানান, ‘সেচ প্রকল্পের পাম্প বন্ধ হওয়ার কারণে বোরো চাষে কৃষকদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে অবহিত করেছি। পানির কারণে এবার ফলন কম হবে। ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করে ধান রোপণে কৃষকদের অনেক ব্যয় বাড়বে। কুষ্টিয়া অঞ্চলে ৫৪৬ হেক্টর জমি পানির অভাবে চাষ হচ্ছে না। এতে কুষ্টিয়া অঞ্চলেই প্রায় ২৫শ মেট্রিক টন খাদ্য ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে।’
কুষ্টিয়া-৩ (ভেড়ামারা-মিরপুর) আসনের সংসদ সদস্য কামারুল আরেফিন বলেন, ‘গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) সেচ প্রকল্পের পানি সংকট নিয়ে জাতীয় সংসদে কথা বলেছি। সেচ প্রকল্পের জন্য ১২শ কোটি ও জিকে প্রকল্পের সার্বিক উন্নয়নের জন্য ১২শ কোটি মোট ২৪শ কোটি টাকার একটি প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে যাচাই বাছাইয়ের কাজ চলছে। খুব তাড়াতাড়ি এ প্রকল্প একনেকে পাশ হবে বলে আমি আশাবাদী। কুষ্টিয়া জেলায় সুপেয় পানির জন্য ২শ ৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে এ অঞ্চলে আর পানির সমস্যা থাকবে না।’
ভেড়ামারায় গঙ্গা-কপোতাক্ষ (জিকে) প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, ‘দুটি পাম্প আগে থেকেই নষ্ট ছিল। ৩য় পাম্পটি দিয়ে ৩১ জানুয়ারিতে ক্যানেলে পানি সরবরাহ শুরু হয়। কিন্তু কারিগরি ত্রুটির কারণে ১৯ ফেব্রুয়ারি ওই পাম্পটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর জাপানের ইবারা করপোরেশনের সাথে যোগাযোগ করে পাম্পটি সচল করা হয়েছে কিন্তু ইনটেক চ্যানেলে স্বাভাবিক পানির স্তর না থাকায় সেচ কার্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না। সেচের জন্য পদ্মায় পানি বৃদ্ধির অপেক্ষা করতে হচ্ছে।’
কুষ্টিয়ার পওর বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান বলেন, ‘চার জেলার ১৩টি উপজেলায় জিকের সেচ কার্যক্রম বিস্তৃত। প্রকল্পের প্রধান তিনটি খাল, ৪৯টি শাখা খাল ও ৪৪৪টি উপশাখা খাল রয়েছে। পানি সমস্যা সমাধানে সরকার অত্যন্ত আন্তরিক। এ সমস্যা হয়তো বেশিদিন থাকবে না।