Logo
×

Follow Us

জেলার খবর

১৬ বছরে প্রায় তিন লাখ তালগাছ বুনেছেন চিত্তরঞ্জন

Icon

আব্দুল্লাহ সুমন

প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪, ১৯:২১

১৬ বছরে প্রায় তিন লাখ তালগাছ বুনেছেন চিত্তরঞ্জন

তালগাছ বুনছেন চিত্তরঞ্জন দাস। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

১৬ বছর আগে ভারতে বেড়াতে গিয়েছিলেন চিত্তরঞ্জন দাস। সেখানেই জানতে পারেন আমেরিকার এক বিজ্ঞানী বলেছেন, তালগাছের অনেক গুণ। সবচেয়ে বড় কথা মাথা উঁচু এ গাছটি বজ্রপাতকে দুর্বল করে দেয়।

তালগাছ নিয়ে বিজ্ঞানীর কথাটা খুব মনে ধরেছিল চিত্তরঞ্জনের। শুনেই মনে হয়েছিল, প্রায়ই তার আশপাশের গ্রামে ঠাডা (বজ্রপাত) পড়ে মানুষ মরে এবং তালগাছ নেই বলে বাবুই পাখিও আর বাসা বাঁধে না। তালগাছ নিয়ে এ রকম নানা চিন্তা তার মাথায় ঘুরতে লাগল। চিত্তরঞ্জনের বাবা বৃক্ষ রোপণ করতেন। বাড়িতে তালগাছও লাগিয়েছিলেন তিনি। চিত্তরঞ্জন ঠিক করলেন, এবার বাবার সেই গাছের বীজ লাগাবেন বিলের রাস্তার দুই ধারে।

শুরু করলেন তা দিয়েই। কিন্তু একটা তালগাছ থেকে আর কটা বীজ পাওয়া সম্ভব! ফলে মন ভরল না তার। ঠিক করলেন, আশপাশের গ্রামে ঢুঁ মারবেন তালের বীজের খোঁজে। কিছুদিনের মধ্যে হাজারখানেক বীজ সংগ্রহ করে তাক লাগিয়ে দিলেন প্রায় দুই কিলোমিটার দীর্ঘ ধোপাদী-মশিয়াহাটী সড়কের দুই ধারে। এভাবে প্রথম বছর প্রায় আড়াই হাজার বীজ লাগিয়েছিলেন তিনি।

এরপর থেকে তালগাছ লাগানোর নেশা আর ছাড়েনি চিত্তরঞ্জনকে। গত ১৬ বছরে তিন লাখের কাছাকাছি (দুই লাখ ৮৮ হাজার) তালের বীজ যশোরের অভয়নগর উপজেলাসহ, নওয়াপাড়া পৌর এলাকা ও মনিরামপুরের ৪২টি ছোট-বড় সড়কের দুই ধারে। ৫৬ হাজার খেজুরগাছের বীজও রোপণ করেছেন তিনি।

২০০৮ সালে বোনা বীজগুলো বড়সড় গাছ হয়ে এরই মধ্যে উঁকি মারছে আকাশে। এই গরমে গাছের তলায় বসে মানুষ গল্প করছে। তাল পাকলে নিয়ে যাচ্ছে। বজ্রপাতের সময় ক্ষেত থেকে উঠে এসব গাছের নিচেই নিরাপত্তা খোঁজেন স্থানীয় কৃষকরা। এসব দেখে খুব ভালো লাগে তার। তালগাছ ছিল না বলে এত বছর ধরে এলাকায় বাবুই পাখির খুব একটা দেখা মিলত না। এখন সে পাখিরা আবার ফিরছে। ওদের দেখে মন ভরে যায় চিত্তরঞ্জনের।

তিনি বলেন, ‘আমি গরিব মানুষ। লেখাপড়া জানি না। গাছগুলো মানুষকে ছায়া দেয়, বজ্রপাত ঠেকায়, ফল দেয়, অক্সিজেন দেয়। যাদের টাকা আছে তারা মানুষের জন্য অনেক কিছু করে। কিন্তু গাছ লাগানো ছাড়া মানুষের উপকার করার অন্য উপায় জানা নাই আমার!’

ভবদহ এলাকার জলাবদ্ধতার কারণে এ পর্যন্ত চিত্তরঞ্জনের কষ্টে লাগানো কয়েক হাজার গাছ নষ্ট হয়ে গেছে। কিছু গাছ স্থানীয়রা নষ্ট করেছে, কিছু উপড়ে ফেলা হয়েছে রাস্তা সংস্কারের সময়। আবার গরমের সময় হাতপাখা ব্যবসায়ীরা ছোট ছোট গাছের পাতা কেটে নিয়ে যায়। এভাবে অনেক চারা নষ্ট হয়েছে।

শুধু তালের বীজ রোপণ করেই ক্ষান্ত হন না চিত্তরঞ্জন দাস। নিয়মিত গাছগুলোর পরিচর্যাও করেন। কোমরে গামছা বেঁধে প্রায়ই ছুটির দিন তার নাতি-ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে বিভিন্ন গ্রামের উদ্দেশে বাড়ি থকে বেরিয়ে পড়েন সাইকেলে। সঙ্গে থাকে কোদাল, পানির বোতল ও দা। চারার নিচে আগাছা হলে তুলে ফেলেন। বৃষ্টিতে মাটি সরে গেলে জমি থেকে মাটি নিয়ে তা ভরে দেন। গাছ বাঁচানোর কাজে স্থানীয়দেরও যুক্ত করার চেষ্টা করেন।

কোথাও তালবীজের খোঁজ পেলে চিত্তরঞ্জন ছুটে যান। ভবদহ অঞ্চলের ৫০টি গ্রাম থেকে তালবীজ কেনেন নিজ খরচে। আবার বিনা পয়সায় কেউ বীজ দিলে খুশিমনে তা নেন। বর্ষা মৗসুমে বাড়ি বাড়ি ঘুরে, এমনকি আবর্জনার স্তূপ থেকেও তালবীজ সংগ্রহ করেন। একেকটা বীজ কিনতে সব মিলিয়ে চার টাকার মতো খরচ হয় তার। নিজের আয়ের একটা অংশ খরচ করেন এর পেছনে। প্রথম দিকে চিত্তরঞ্জনের পরিবারের লোকজন তাকে বকাঝকা করত। এখন তারাও সহযোগিতা করে।

অন্য জেলায়ও যাচ্ছেন

এখন যশোরের সীমানা পরিয়ে দেশের অন্যান্য জেলাতেও এই কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে দিচ্ছেন চিত্তরঞ্জন। গত বছর আমার ফেসবুক পেজ থেকে চিত্তরঞ্জন দাসের তালের বীজ লাগানোর ভিডিও প্রায় ২ কোটি মানুষ দেখে। সেখান থেকে সারা দেশে তার ব্যাপক পরিচিতি ঘটে। সেই থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা এবং পিরোজপুরের কাউখালীতে ১০ হাজার তালবীজ লাগিয়েছিলেন। কাজে সন্তুষ্ট হয়ে এ দুই জায়গা থেকে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সেটাই ছিল তার জীবনে পাওয়া প্রথম পুরস্কার। ওই পুরস্কারের টাকার অর্ধেক খরচ হয়েছিল। বাকি টাকার সঙ্গে নিজের ৩০ হাজার মিলিয়ে এবার মোট ৫০ হাজার টাকার তালবীজ কিনেছেন। এ বছর আরও ২০ হাজার টাকার বীজ কিনবেন বলে জানালেন তিনি।

ভাদ্র-আশ্বিন বাংলা বর্ষপঞ্জির এই দুটি মাস চিত্তরঞ্জনের অবসর মেলা ভার। ভোরে ঘুম থকে উঠে সাইকেল আর কোদাল নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। একজন ভ্যানঅলা সঙ্গে চলে তালের বীজ নিয়ে। কাজ শেষ করে ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায়। রোদ, ঝড়-বাদল যা-ই হোক না কেন, চিত্তরঞ্জন বলেন, ‘ভাদ্র-আশ্বিন এই দুই মাস তালগাছ না লাগালে আমার হাত নিশপিশ করে। বাড়িতে বসে থাকতে পারি না। যত দিন বাঁচব কাজটা চালিয়ে যাব।’ 

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫