
ডুলাহাজরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
কক্সবাজার জেলার চকরিয়া উপজেলার ডুলাহাজারা রিজার্ভ ফরেস্টে মনোরম প্রাকৃতিক বনাঞ্চলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। ৩০০ হেক্টর এলাকা নিয়ে ২০০১ সালে দেশের প্রথম সাফারি পার্ক হিসেবে কক্সবাজারে এর যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে আয়তন বৃদ্ধি করে ৯০০ হেক্টর করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ২৩ বছর পার হলেও, এখনো এখানে বিশ্বমানের কোনো পরিচালনা পদ্ধতি গড়ে ওঠেনি।
একসময় এখানকার চিরসবুজ বনাঞ্চলে ছিল গগনচুম্বী গর্জন, বৈলাম, তেলসুর, সিভিট, চাপালিশ, চম্পা ফুল ও বিবিধ লতাগুল্মসমৃদ্ধ। বনাঞ্চলে দেখা যেত হাতি, বাঘ, হরিণ, ভালুক, বানরসহ অসংখ্য প্রজাতির পাখি ও সরীসৃপ। এই স্থানে ১৯৮২ সালে তৎকালীন কক্সবাজার বন বিভাগ কর্তৃক ৪২ দশমিক ৫ হেক্টর এলাকা নিয়ে একটি হরিণ প্রজননকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। উঁচু, নিচু টিলাসমৃদ্ধ চিরসবুজ এই বনাঞ্চলের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়নের লক্ষ্যে হরিণ প্রজননকেন্দ্রটির পরিসর বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ এবং অবৈধ শিকার ও পাচারের কারণে এ বনাঞ্চলের অসংখ্য উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী হারিয়ে যেতে থাকে।
সপ্তাহের ছয় দিন দর্শনার্থীদের উচ্ছ্বাসে, প্রাণিকুলের কোলাহলে মুখরিত হয়ে ওঠে ডুলাহাজরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক। প্রাপ্ত বয়স্করা ৫০ টাকা, ৫ বছরের কম বয়স্ক শিশুদের টিকিট ফ্রি এবং ৫ বছরের বড় শিশু-কিশোররা ৩০ টাকা টিকিটে পার্ক দর্শন করতে পারেন।
বর্তমানে পার্কে আবদ্ধ বন্যপ্রাণীর সংখ্যা ৪১০টি। এর মধ্যে স্তন্যপায়ী প্রাণী ১২৩টি, সরীসৃপ প্রজাতির প্রাণী ৬৩ এবং পাখি রয়েছে ২২৪টি। এ ছাড়া উন্মুক্ত প্রাণীর সংখ্যা প্রায় ২৫০০-৩০০০। পার্কের বেষ্টনীতে কঠোর নিরাপত্তায় পালিত হচ্ছে-হাতি, বাঘ, সিংহ, জলহস্তী, গয়াল, আফ্রিকান জেব্রা, ওয়াইল্ডবিস্ট, ভালুক, বন্য শূকর, হনুমান, ময়ূর, স্বাদু ও নোনা পানির কুমির, সাপ, বনগরুসহ দেশি-বিদেশি নানা প্রজাতির প্রাণী। পার্কজুড়ে রয়েছে চিত্রা, মায়া, সম্বর ও প্যারা হরিণ।
রয়েছে জানা-অজানা বিচিত্র কয়েকশ ধরনের পাখি। পার্কে দেখা মেলে কালের সাক্ষী বিশালাকার দুর্লভ ও মূল্যবান বৃক্ষরাজির। সে সব গাছে বানরের লাফালাফি নজর কাড়ে দর্শনার্থীদের।
সাফারি পার্কের ইনচার্জ (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, প্রাণীর দেখভাল ও পরিচর্যায় আমাদের লোক আছেন ৫৫ জন, প্রাণী অনুপাতে পার্কে লোকবল দরকার ৭৭ জন। তবু আমরা বাড়তি দায়িত্ব নিয়ে কর্তব্য পালন করে যাচ্ছি।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী-পার্কটিকে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের সাফারি পার্কে রূপান্তর করার লক্ষ্যে অনুমোদিত মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন মেয়াদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক কক্সবাজার উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ (২য় পর্যায়) প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে, যা শেষ হবে ২০২৫ সালের জুন মাসে।
আইইউসিএন-২০১৬-এর বাংলাদেশের লাল তালিকা এবং অন্যান্য তথ্য অনুযায়ী ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে বিলুপ্ত ও বিপদগ্রস্ত প্রাণীর তালিকায় আছে দুই প্রজাতির গন্ডার, দুই প্রজাতির ভালুক, বনগরু, বুনো মহিষ, বান্টেং, রামকুত্তা, নেকড়ে, সবুজ ময়ূর, বাদি হাঁস, গোলবাহার সাপসহ বহু জানা-অজানা ছোট ছোট প্রজাতির স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ, উভচর, মাছ এবং অমেরুদণ্ডী প্রাণী ও উদ্ভিদ।
চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্ক বিশেষজ্ঞ ড. রেজা খান জানান, বিশ্বমানের সব সাফারি পার্কেই একটি মানসম্পন্ন পরিচালন পদ্ধতি বা স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) থাকে। ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্কে এ জিনিসের অস্তিত্ব নেই। বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ সংরক্ষণ বা এ সংক্রান্ত সচেতনতামূলক দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচি কোথাও আছে বলে দেখিনি। বাংলাদেশের দুটি সাফারি পার্কই নিম্নমানের চিড়িয়াখানার বৃহদাকার সংস্করণমাত্র। বিশ্বের কোনো সাফারির মানদণ্ডে এরা টেকে না। এর জন্য জরুরি ভিত্তিতে দরকার সরকারের পক্ষ থেকে একটি বন্যপ্রাণী নীতি প্রণয়ন এবং সেটির অধীনে একটি স্বায়ত্তশাসিত বন্যপ্রাণী বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা।
সাফারি পার্ক শিক্ষার্থী ও প্রকৃতি গবেষকদের জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে অনেক সহায়ক। সাফারি বলতে, পার্কে থাকা প্রাণীগুলো উন্মুক্ত থাকবে, আর দর্শনার্থীরা থাকবে খাঁচায় আবদ্ধ। চলন্ত গাড়িতে ঘুরে তারা বন্যপ্রাণী দেখে নিজের অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করবেন। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো সেভাবে সাফারি পার্ক গড়ে তোলা যায়নি। দক্ষিণ এশীয় পদ্ধতিতে চলছে পার্ক কার্যক্রম। পার্কে থাকা প্রতিটি প্রাণীর জন্য আলাদা বেষ্টনী রয়েছে। রয়েছে আলাদা খাবার সংরক্ষণ ও প্রাণীদের পরিচর্যার ব্যবস্থা। প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরে ডুলাহাজারা সাফারি পার্কটি এ অঞ্চলে বিনোদনের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে বার্ষিক পিকনিক করতে আসছে অনেক শিক্ষা ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। তাই পার্কের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হচ্ছে নতুন করে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ চট্টগ্রামের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী জানান, বর্তমানে পার্কটিতে আধুনিকায়নের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালের জুন মাসে। কোভিড-১৯-এর কারণে প্রথম দুই বছর কোনো কার্যক্রম বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি, তাই প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হলে পাল্টে যাবে পার্কের চিত্র। সেই সঙ্গে পরিবর্তন হবে অনেক কিছু। ইতোমধ্যে পার্কের অনেক কাজ দৃশ্যমান হয়েছে।