
আলতাদীঘি। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল
অনেক অনেক দিন আগের কথা। নওগাঁ এলাকায় ছিলেন এক রাজা, নাম বটু রাজা। জগদ্দলে ছিল সেই রাজার বাড়ি। তার ছিল এক দয়াবতী রানী। রানী একদিন আবদার করলেন, বড় এক দীঘি খুঁড়ে দিতে হবে। রাজা বললেন, ঠিক আছে। তুমি হাঁটতে শুরু কর। যে পর্যন্ত গিয়ে তোমার পা ফেটে রক্ত বের হবে, সেই পর্যন্ত দীঘি কাটা হবে। রানী হাঁটতে থাকলেন, কিন্তু হাঁটা আর শেষ হয় না। রাজা পড়ে গেলেন চিন্তায়। শেষ পর্যন্ত পাশের দেশে গিয়ে দীঘি কাটতে না হয়। তাই কৌশলে সৈন্য দিয়ে রানীর পায়ে আলতা লাগিয়ে বললেন, রানীর পা ফেটে রক্ত বেরিয়েছে। দীঘি সে পর্যন্তই খোঁড়া হলো। ধীরে ধীরে সে দীঘি ভরে গেল টলটলে কাকচক্ষু জলে। তাতে পদ্ম ফুটল। প্রজাদের পানীয়জলের কষ্ট শেষ হলো। আর সে থেকেই এর নাম হলো আলতাদীঘি। প্রায় হাজার বছরের স্মৃতি নিয়ে আজও সৌন্দর্য বিলিয়ে যাচ্ছে এই ঐতিহ্যবাহী আলতাদীঘি।
এত প্রাচীন আর এমন বিশাল দীঘি বাংলাদেশে আর কোথাও আছে কিনা সন্দেহ রয়েছে। উত্তর-দক্ষিণে লম্বা এ দীঘির দৈর্ঘ্য প্রায় এক কিলোমিটার, চওড়া ৪০০ মিটারের মতো। দীঘির পাড় ঘেঁষে ভারত সীমান্ত। উত্তর পাড়ে দাঁড়িয়ে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া, বিএসএফের সীমান্ত টইল, যেখান থেকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতকে দেখা খুবই সহজ। সম্প্রতি উদ্যানের দীঘি খনন, ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ ও গাছ রোপণসহ বেশ কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে কাটা পড়েছে নানা প্রজাতির হাজারো গাছ।
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার ‘আলতাদীঘি পুনঃখননের মাধ্যমে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যানের জীববৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণ’ প্রকল্পের নামে ঐতিহ্যপূর্ণ দীঘিটির চতুর্দিকের কয়েক হাজার গাছ নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে। বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সামাজিক বনায়নের আওতায় ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি প্রজাতির চারা দ্বারা বনায়নকৃত গাছগুলো অপসারণ করে স্থানটি দেশীয় প্রজাতির চারা প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা হয়েছে।
আলতাদীঘির খননকৃত মাটি দিয়ে নিচু স্থান ও পাড় সংস্কার করার জন্য দীঘির চারপাশে বিদ্যমান ৫৪৬টি ইউক্যালিপটাস ও ৪৫৬টি আকাশমণি গাছ পঁয়ত্রিশ লাখ পঁচানব্বই হাজার দুইশ ছাপ্পান্ন টাকায় টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি করা হয়। পরিবেশকর্মীদের অভিযোগ, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই অজুহাতে ইউক্যালিপটাস গাছ কাটার বিষয়টি হয়তো মেনে নেওয়া যায়। তবে দীঘির চতুর্দিকে সারিবদ্ধভাবে লাগানো পরিবেশবান্ধব বিশাল আকৃতির ৪৫৬টি আকাশমণি গাছ কাটার বিষয়টি অযৌক্তিক। উন্নয়ন প্রকল্পের নামে এখন খাঁ-খাঁ করছে আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান।
স্থানীয়দের অভিযোগ, দীঘিটি অবশ্যই সংস্কার জরুরি। কিন্তু গাছগুলো রেখে কি সংস্কার করা যেত না? এ যেন এক মরুভূমি। গাছ কাটার আগে যেসব জায়গায় পাখির বাসা ছিল, এখন সেখানে বালুর স্তূপ।
উদ্যানের উন্নয়ন কাজে গঠিত কমিটির সদস্য কায়েস উদ্দিনের দাবি, আলোচনা সভায় গাছ কাটার সিদ্ধান্ত হয়নি। হঠাৎ করে আলতাদীঘিতে এসে দেখি গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) নওগাঁ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাফকুল ইসলাম বলেন, ‘আজকের কর্তনকৃত গাছগুলো হতে সময় লেগেছে ১৫ থেকে ২০ বছর। অথচ নিমিষের মধ্যে তা ধ্বংস করা হচ্ছে। আধুনিক নকশায় গাছ রেখেই সুন্দর পরিকল্পনা করা সম্ভব।’
তিনি আরও বলেন, ‘আলতাদীঘি জাতীয় উদ্যান এ অঞ্চলে ফুসফুসের মতো কাজ করে। আমরা এ বিষয়ে অনেক মিটিং মিছিল মানববন্ধন করেছি কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয়নি। পুরনো হাজার হাজার গাছগুলো যারা নির্বিচারে কাটছেন তারা অবশ্যই অপরাধ করছেন। এসব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
বন বিভাগ সূত্র বলছে, দেশীয় প্রজাতির ৩০০০টি চারা দ্বারা চারপাশে বনায়নসহ দীঘিটিতে যেন পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি থাকে তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা চলতি অর্থবছরে নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির কাজ ডিসেম্বর ২০২৪ সালে সমাপ্ত হলে পুরো আলতাদীঘি এলাকা আবার সবুজে পরিণত হতে শুরু করবে। দীঘির পানির প্রাপ্যতা নিশ্চিত ও বনাঞ্চল ব্যবস্থাপনার সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হবে। পাশাপাশি পরিবেশের উন্নয়ন, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র্য বিমোচন এবং ইকো ট্যুরিজমের সুযোগ সৃষ্টি করা হবে।