Logo
×

Follow Us

জেলার খবর

ভিয়েতনামের নোন-লা আমাদের মাথাল

Icon

আবদুল্লাহ মাহফুজ অভি

প্রকাশ: ০৯ জুন ২০২৪, ১৯:০৭

ভিয়েতনামের নোন-লা আমাদের মাথাল

মাথাল পরে বসে আছেন একজন কৃষক। ছবি: লেখক

বাইরে তখন তীব্র রোদ। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি। কিন্তু গরম অনুভূত হচ্ছে আরও বেশি। এমন পরিস্থিতিতে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার এক গ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল কৃষক মিজানুর রহমানের সঙ্গে। তার মাথায় মাথাল দেখে প্রশ্ন করলাম মাথালটির দাম কত? কোথা থেকে কিনেছেন? মাথালটি ধরে মিজানুর রহমান জানালেন, এটা নওগাঁর এক কৃষক দিয়েছেন। তাই এটার দাম তিনি জানেন না। কিন্তু তাদের কুষ্টিয়ার মাথালগুলো আরেকটু শক্ত হয়।

এরপর তার কাছে জানতে চাইলাম, মাথাল ব্যবহার করেন কেন? এখন তো এর ব্যবহার কমে গেছে? অনেকেই তো ক্যাপ পরেন, কেউ গামছা বাঁধেন। উত্তরে ড্যানি বললেন, ‘মাথালে যে পরিমাণ ঠান্ডা হয় তা অন্য কিছুতে হয় না। মাথাল শুধু মাথাই না, শরীরও ঠান্ডা রাখে।’ বলতে বলতে তিনি তার গলা ও কাঁধের অংশ হাত দিয়ে দেখালেন। তার মতে, এই গরমে মাথালের চেয়ে উপকারী কিছু নেই। 

মিজানুর রহমানের কাছে জানতে চাইলাম, মাথালের ব্যবহার তাহলে আগের চেয়ে কমে গেছে কেন? উত্তরে শুধু বললেন, ‘এখন অনেক কিছুই বদলে গেছে, আগের দিন তো আর নেই...।’ 

রোদ বৃষ্টি থেকে বাঁচতে কৃষকদের মাঝে একসময় মাথালের ব্যবহার ছিল। শুধু কৃষক না, রাখাল, মাঝি, হাটুরেসহ মাঠ পর্যায়ের নানা শ্রমজীবী মানুষরা মাথাল ব্যবহার করতেন। যদিও এখন এটা প্রায় বিলুপ্তির পথে। 

রোদ বৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা পেতে মাথালের ব্যবহারের ইতিহাস হাজার বছরের। আমাদের দেশে মাথালের ব্যবহার ঠিক কত বছর পূর্বে তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হয় ৩০০০ বছর পূর্বে মাথালের ব্যবহার শুরু হয় ভিয়েতনামে। এ নিয়ে ভিয়েতনামে একটি প্রচলিত গল্প আছে-রোদ বৃষ্টিতে মানুষের কষ্ট দেখে এক দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এক দেবী পৃথিবীতে এসে নোন-লা মানে মাথাল দিয়ে মানুষকে রক্ষা করেন। মাথালটি তৈরি করতে তিনি ব্যবহার করেন চারটি বড় পাতা এবং তার হাতের বাঁশের লাঠি। কৃষকদের নানা রকম সবজি চাষও শেখান। এরপর একদিন উধাও হয়ে যান।

কিন্তু স্থানীয়রা তার কাছে থেকে শিখে নিয়েছিল মাথাল বানানোর কৌশল। সেই থেকে ভিয়েতনামের মানুষ মাথাল ব্যবহার করে। ভিয়েতনামি নোন-লা মানে ‘পাতার টুপি’, মূলত এক প্রকার পাতা, বেত বাঁশ দিয়ে এই মাথাল তৈরি করা হয়। মনে করা হয় ভিয়েতনাম থেকেই মাথালের প্রচলন শুরু হয়েছে।

মাথালের ব্যবহার পুরো এশিয়া জুড়েই রয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় বলে সেরাং, থাইল্যান্ডে বলে নগুপ, চীন, তাইওয়ান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভারত বাংলাদেশসহ এশিয়ার প্রায় সব দেশেই ব্যবহার হয়। বাংলাদেশে অঞ্চল ভেদে মাথালের বিভিন্ন নাম শোনা যায়। যেমন-মানিকগঞ্জে মাথালকে বলা হয় মাতাইল, কুড়িগ্রামে বলা হয় ঝাঁপি, চট্টগ্রামে জুইর, টাঙ্গাইলে মাথোল, পঞ্চগড়ে ভাতি, নড়াইল ও ভোলায় টুয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও নেত্রকোনায় পাতলা, মৌলভীবাজারে ছাতা, পটুয়াখালী ও বাগেরহাটের দিকে একে জুমলা বলা হয়। তবে মাথাল নামটি সব অঞ্চলেই পরিচিত। 

বাংলাদেশে সাধারণত কৃষি শ্রমিকরা মাথাল ব্যবহার করলেও ভিয়েতনামে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার, এমনকি শহুরে মানুষও নিত্যনৈমিত্তিক কাজে পথ চলতে মাথাল ব্যবহার করেন।

মাথাল আবিষ্কার নিয়ে ভিয়াতনামে কিংবা প্রচলিত গল্পে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবতা কিন্তু তেমনই। বিরূপ আবহাওয়ায় খোলা আকাশের নিচে কর্মরত শ্রমজীবীদের কাছে মাথাল কিন্তু একটি নিরাপদ আশ্রয়। মাথালের ব্যবহার রোদ ও গরম বৃষ্টিতে যেমন শ্রমবান্ধব, তেমনি এর উপকরণগুলো পরিবেশবান্ধব ও পরিবেশ উপযোগীও। আগে প্রচণ্ড- বৃষ্টিতে ব্যবহার হতো মাথালের মতোই আরেকটি বস্তু যা আরও বড় এবং শরীর-পিঠ ঢেকে রাখে। একে বলা হয় জোংরা। এর ব্যবহার এখন নেই বললেই চলে। বছর দুই আগে বান্দরবানের থানচিতে এক আদিবাসী নারীকে দেখেছিলাম বৃষ্টিতে জোংরা ব্যবহার করতে। এরপর আর কোথাও চোখে পড়েনি। এগুলো সবই এখন বিলুপ্তপ্রায়।

মাথালের একটি বিকল্প হলো ছাতা। কিন্তু ছাতা হাতে ধরে রেখে তো আর মাঠে, ময়দানে কাজ করা যায় না। তাই শ্রমজীবীদের কাছে এটি ততটা কাজের জিনিস নয়। বরং তারা আবার মাথাল ব্যবহার শুরু করলে একদিকে যেমন তীব্র রোদে গরমে বৃষ্টিতে উপকার পাবে, তেমনি গ্রামীণ কারিগরদেরও কর্মসংস্থান বাড়বে।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫