
রথযাত্রা। ছবি: সংগৃহীত
“ধামরাই রথ, কোন অতীতের বৃদ্ধ সূত্রধর
কতকাল ধরি গড়েছিল এরে করি অতি মনোহর।
সূক্ষ্ম হাতের বাটালি ধরিয়া কঠিন কাঠেরে কাটি,
কত পরী আর লতাপাতা ফুল গড়েছিল পরিপাটি।
রথের সামনে যুগল অশ্ব, সেই কতকাল হতে,
ছুটিয়া চলেছে আজিও তাহারা আসে নাই কোনোমতে।”
কবি জসীমউদ্দীনের ‘ধামরাই রথ’ কবিতার এই চরণগুলো মনে মনে আবৃত্তি করতে করতে গুলিস্তান থেকে উঠে পড়লাম ‘গুলিস্তান টু ধামরাই’ বাসে। বাস চলছে অচেনা পথে, রথের পথে থামবে গাড়ি? নাকি নিয়ে যাবে গাড়ির বাড়ি? মাথায় যখন এই চিন্তা দৌড়াদৌড়ি করছিল ঠিক সে সময় বাসের তরুণ কন্ডাক্টর মৃদু হাসি দিয়ে আশ্বস্ত করল, ‘রথযাত্রা দেখতে যাবেন তো, আমাদের বাস যেখানে একেবারে থেমে যাবে তার অল্প দূরেই।’ পাশের সিটে বসা প্রবীণ মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমের সফেদ দাড়ি বাতাসে দোল খাচ্ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় পেরিয়ে যাওয়ার সময়। ধামরাইয়ের শেষ প্রান্তে তার বাড়ি। গল্পটাও জমল তখন এই প্রবীণের সঙ্গে। জানালেন, ‘দেশ স্বাধীনের আগে দেখেছি ধামরাইয়ের সেই বিখ্যাত কাঠের রথ। অনেক বড় ছিল সে রথ, চমৎকার কাঠের কারুকার্য ছিল তাতে। রণদাপ্রসাদ সাহা আসতেন প্রত্যেকবার, রথযাত্রা উদ্বোধন করতে। মানুষের ভিড়, হৈহুল্লোড়! সেই রথটা যুদ্ধের সময় পুড়িয়ে দিল পাকিস্তানি আর্মি। রণদাপ্রসাদ সাহাকেও মেরে ফেলল। স্বাধীনতার পর তার মেয়ে আসত রথ যাত্রায়।’
গন্তব্য এসে যাওয়ায় জাহাঙ্গীর বিদায় নিলেন, খানিক বাদে আমারও নামতে হলো, ধামরাই এসে গেছে। শেষ স্টেশন। ভর দুপুর, কিছুটা উত্তপ্তও। অদূরেই রথযাত্রার স্থল। দাঁড়িয়ে আছে প্রকাণ্ড রথ, তাকে ঘিরে ভিড় বাড়ছে ক্রমশ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কায়েতপাড়ার রথখোলা রাস্তা ভরে গেল মানুষে। রথের দড়িতে টান পড়ল শেষ বিকেলে, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ ছিলেন এ দৃশ্য দেখার অপেক্ষায়। চারদিকে শুরু হলো হইহল্লা, হুড়োহুড়ি, রথ লক্ষ্য করে কলা ছোড়া। এরই মধ্যে রথের দড়ি ধরতে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে পড়ে দুজন নারী-প্রায় পদদলিত হতে হতে বাঁচলেন! বোধহয় এমনতর দৃশ্যের কথা ভেবেই কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-
“উড়িয়ে ধ্বজা অভ্রভেদী রথে
ওই যে তিনি, ও-ই যে বাহির পথে।
আয়রে ছুটে, টানতে হবে রশি,
ঘরের কোণে রইলি কোথায় বসি।
ভিড়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ে গিয়ে
ঠাঁই করে তুই নে রে কোনো মতে।”
যশোমাধবকে রথে করে কায়েতপাড়ার রথখোলা থেকে প্রধান সড়ক ধরে নিয়ে যাওয়া হয় পৌর এলাকার গোপন ঘরে। নয় দিন অবস্থানের পর উল্টো রথযাত্রা উৎসবের মাধ্য দিয়ে আবার রথখোলায় নিয়ে আসা হবে। যশোমাধব ও অন্য মূর্তিগুলোকে রাখা হবে মন্দিরে এবং রথটি সারা বছর থাকবে রথখোলায়।
ধামরাই যশোমাধব মন্দির পরিচালনা পর্ষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নন্দ গোপাল সেন এই রথযাত্রার ইতিহাস বিষয়ে জানালেন, ‘বালিয়াটির জমিদারগণ বাঁশের রথ দিয়ে এই রথযাত্রার প্রবর্তন করেছেন। এ অঞ্চলটা তখন নদীবিধৌত ছিল, কাশবন পরিষ্কার করে তারা রথযাত্রার প্রচলন করেছেন। পরবর্তীকালে ৭৫ ফুট উঁচু কাঠের কারুকার্য মণ্ডিত পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রথ তৈরি করে। জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হওয়ার পর মির্জাপুরের রায়বাহাদুর রণদাপ্রসাদ সাহা এ রথ দেখভাল করতেন এবং রথযাত্রা পরিচালনা করতেন। রণদাপ্রসাদ সাহা পুত্রসহ নিখোঁজ হলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে, আমাদের সুবিশাল রথখানিও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। তারপর মন্দির পরিচালনা কমিটি বাঁশের রথ তৈরি করে। বহু বছর পর ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ধামরাইয়ের সুকান্ত মেটালসে এলে রথের বিষয়ে সুকান্ত বণিকের কাছে শোনার পর তার প্রচেষ্টায় এক কোটি টাকা ব্যয়ে ভারত সরকার রথটি তৈরি করে দেয়।’
ধামরাইয়ের ঐতিহাসিক রথযাত্রার প্রচলন নিয়ে কিংবদন্তি রয়েছে, একদা পাল বংশের রাজা যশোপাল হাতির পিঠে চড়ে বেড়াতে যান ধামরাইয়ের শিমুলিয়ার কাছে এক গ্রামে। রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ রণস্থান নামের একটি জায়গায় উঁচু লাল মাটির ঢিবি দেখতে পেয়ে রাজাকে বহনকারী হাতিটি থেমে যায়। হাতির মাহুতের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও কিছুতেই হাতিটি আর এগোচ্ছিল না। তখন রাজা ভীষণ অবাক হলেন। তিনি হাতি থেকে নেমে গ্রামবাসীকে লাল মাটির ঢিবিটি খননের নির্দেশ দেন। খননের একপর্যায়ে সেখানে একটি সুরক্ষিত মন্দির এবং বিষ্ণু মূর্তির অনুরূপ একটি মাধব মূর্তি পাওয়া যায়। ধামরাই সদরের ঠাকুরবাড়ির পণ্ডিত রামজীবন রায়কে মাধব মূর্তি প্রতিস্থাপনের দায়িত্ব দেন রাজা। মাধবের নামের সঙ্গে রাজা যশোপালের নাম যুক্ত হয়ে বিগ্রহটির নাম হয় ‘শ্রীশ্রী যশোমাধব’। এই বিগ্রহকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে ‘শ্রীশ্রী যশোমাধব মন্দির’। শুরু হয় রথযাত্রা ও মেলা।