Logo
×

Follow Us

জেলার খবর

যেখানে দেখিবে ছাই...

Icon

দীপংকর গৌতম

প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৪, ২২:২৫

যেখানে দেখিবে ছাই...

পরিত্যক্ত ছাই-মাটি ধুয়ে সোনা বের করে আনছেন মানিকগঞ্জের ‘ছালি ব্যবসায়ীরা’। ছবি- সাম্প্রতিক দেশকাল

তারা ছাই থেকে সোনা বানায়। গত দেড়শ বছর ধরে স্বর্ণকারদের কাজের জায়গার পরিত্যক্ত ছাই-মাটি ধুয়ে সোনা বের করে আনছেন মানিকগঞ্জের ‘ছালি ব্যবসায়ীরা’। ‘ছালি ব্যবসায়ী’ মানিকগঞ্জের স্থানীয় ভাষা। ছাই নিয়ে ব্যবসা করার কারণে পেশার নাম এটা হয়েছে বলে মনে করা হয়। 

জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে ছায়াঢাকা পাখিডাকা জনপদ সিংগাইর উপজেলা। সদর থেকে একটু ভেতরে সিংগাইর সদর ইউনিয়নের গোবিন্দল ও চারিগ্রাম ইউনিয়নের দাশের হাটি, চারিগ্রাম-এসব গ্রামের প্রায় ৫ হাজার পরিবার এই পেশার ওপর নির্ভরশীল। এরা দেশের অর্থনীতিতেও রেখে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এ এলাকার অধিকাংশ লোক স্বর্ণ তৈরি, ক্রয়-বিক্রয়ের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ইতোমধ্যে সারা দেশে এলাকাটি ‘স্বর্ণ গ্রাম’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। এ কাজে পরিবারের পুরুষ সদস্যদের পাশাপাশি নারীরাও সম্পৃক্ত।

এদের কাজ সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে চাইলে গোবিন্দল গ্রামের কারিগর মোস্তাকিম হোসেন জানান, আমরা প্রথমে দেশের বিভিন্ন স্থানের সোনার দোকানের পরিত্যক্ত ছাই-কখনো মাটিও কিনে আনি। কতটুকু ছাইয়ে কতটুকু স্বর্ণ পাওয়া যাবে সে অনুমানের ওপর ভিত্তি করে প্রতি বস্তা (দুই মণের বস্তা) ছাইয়ের দাম ৩-১২ হাজার টাকা পড়ে যায়। ছাই সংগ্রহের পর সেই ছাই পুড়িয়ে প্রথমে ধুলাতে রূপান্তর করা হয়। ধুলার সঙ্গে সোহাগা, ব্যাটারির সিসা ও পুনট দিয়ে ছোট ছোট পি- (দলা) বানানো হয়। তারপর শুকনো দলাগুলো আগুনে গলিয়ে পিচ বানিয়ে ঢেঁকিতে পাড় দিতে হয়। তা গুঁড়ো করে মাটির গর্তে চুন ও ধানের তুষ দিয়ে পুড়িয়ে প্রথমে সিসা বের করে আনা হয়। তারপর ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে পানিতে ধুয়ে সিসা আলাদা করা হয়। এরপর একটি পাত্রের মধ্যে নাইট্রিক অ্যাসিড দিয়ে সিসা থেকে লেগে থাকা সোনা আলাদা করা হয়। এভাবে ছাই থেকে তৈরি হয় সোনা। 

ছাই কেনার প্রধান এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে ঢাকার তাঁতীবাজার, সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় অলঙ্কার তৈরির কারখানাগুলো। প্রতি ৬ মাস পর পর বিপুল পরিমাণ পরিত্যক্ত ছাই কিনে আনার পর চলে সোনা উৎপাদনের কাজ। সম্প্রতি সিংগাইর উপজেলার চারিগ্রাম এলাকার অমর পোদ্দারের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, প্রায় ১৫-২০ জন পুরুষ ও নারী শ্রমিক ব্যস্ত সময় পার করছে ছাই থেকে সোনা উৎপাদনের কাজে। কেউ মাটির চুলোয় সিসা জ্বাল দিচ্ছেন, কেউ পি- তৈরি করে রোদে শুকাচ্ছেন-এমন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত সবাই। নিজস্ব কৌশল অবলম্বন করে ছাই থেকে সোনা বের করার কাজ করছেন। এ প্রসঙ্গে কথা হয় ৬৫ বছরের শ্রমিক সোনা মিয়ার সঙ্গে। তিনি প্রায় ২০ বছর ধরে সোনা উৎপাদন করার কাজ করে আসছেন। তার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই এলাকার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধান পেশা হচ্ছে ছাই থেকে সোনা উৎপাদন করা। পুরুষদের পাশাপাশি গ্রামের নারীরাও নিখুঁত হাতে ছাই থেকে সোনা উৎপাদনের কাজে নিয়োজিত। তাদের উৎপাদিত সোনার কদর জেলা ও জেলার বাইরে দিন দিন বাড়ছেই। ছাই থেকে সোনা উৎপাদনকে কেন্দ্র করে চারিগ্রামে গড়ে উঠেছে একটি জুয়েলারি মার্কেট। অর্ধশত দোকান রয়েছে সেই মার্কেটে। স্বর্ণ বেচা-কেনার বাজার এখানে জমজমাট। প্রতিমাসে ২শ ভরির ওপর কেনা-বেচা হয় এখানে। 

গোবিন্দল গ্রামের সোনার কারিগর শাজাহান জানান, কেমিক্যালের দাম বেড়ে যাওয়ায় এখন লাভ খুব একটা হয় না। সোহাগা, ব্যাটারির ছাইয়ের দাম অনেকাংশে বেড়ে গেছে। এ ছাড়া সবচেয়ে বড় সমস্যায় পড়তে হয় নাইট্রিক অ্যাসিড ক্রয় করতে গিয়ে। স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন এটা নিয়ে ঝামেলা করে। সোনা বিক্রির বেলায়ও যে মহাজনদের কাছ থেকে আগাম বায়না এনে কাজ করতে হয়, তাদের বিষয়টা আগে দেখতে হয়। এই ব্যবসার সঙ্গে এমন বিভিন্ন বিষয় জড়িত যা খোলামেলাভাবে তারা আলাপও করতে পারে না। স্বর্ণের দোকানের পরিত্যক্ত ছাই থেকে খুব পরিশ্রম করে কারিগররা সোনা বের করছে। শত বছরের ঐতিহ্য রক্ষা করে এই পেশাটিকে শুধু বাঁচিয়ে রাখাই নয়, এই শিল্প দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রেখে চলেছে। 

তার পরও নানা কারণে এই পেশার মানুষেরা খুব একটা ভালো নেই। কয়েক হাজার পরিবার এই পেশায় থেকে জীবিকা নির্বাহ করে চলেছে। এত পুরনো পেশা হওয়ার পরও স্থানীয় ব্যবসায়ী হালিম মিয়া বলেন, চার পুরুষের এই পেশাকে আমরা এখনো ধরে রেখেছি। কিন্তু পেশাটিকে টিকিয়ে রাখাটা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ছাই কিনে আনার সময় পথে-ঘাটে প্রশাসনের লোকজন আমাদের নানা ধরনের হয়রানি করে থাকে। সবখানেই হাজার হাজার টাকা দিতে হয়। বাড়িতে এনে কষ্ট করে ছাই থেকে সোনা উৎপাদন করি ঠিকই, কিন্তু তার লভ্যাংশ আগেই পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলে। এ ব্যবসায় সরকারিভাবেও কোনো সহযোগিতা করা হয় না। এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা একান্ত প্রয়োজন।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫