
জীবন চলে দারকি বেচে। ছবি- লেখক
মাছ নিয়ে বাঙালির মনে আছে তীব্র আবেগ ও ভালোবাসা। তাই তো বলা হয় মাছে-ভাতে বাঙালি। ফলে মাছ শিকারও যেন বাঙালি জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। গ্রামাঞ্চলে মৌসুমি জলাশয় বা বিলে নানা সরঞ্জাম দিয়ে মাছ ধরা একটি সুপরিচিত দৃশ্য। এর মধ্যে অন্যতম হলো দারকি।
গ্রামাঞ্চলে বাঁশের শলা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের চাঁই তৈরি করা হয়। এতে থাকে বিভিন্ন আকৃতির খোপ। এতে মাছ ঢোকার রাস্তা আছে, কিন্তু বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। গ্রামাঞ্চলে বর্ষাকালে বন্যার সময় লোকজন মাছ ধরার ফাঁদ পাতেন। সেই ফাঁদগুলোর মধ্যে দারকি অন্যতম।
দারকি বিক্রি করে জীবন চলে দারকি কারিগরদের। দারকির বুননে বুননে মিশে রয়েছে তাদের কষ্টগাথা জীবন। শত কষ্টের মাঝে ধারদেনায় পুঁজি খাটিয়ে বাপ-দাদার পেশাটি আঁকড়ে ধরে আছে এই কারিগররা।
গ্রামের নাম বীর হাতিজা। গ্রামটির মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে জামালপুরের মেলান্দহ-ইসলামপুর উপজেলার সীমান্ত রেখা। এ গ্রামের অধিকাংশই বংশ পরম্পরায় ক্ষুদ্র কুটির শিল্প মাছ ধরার দারকি তৈরি পেশার সঙ্গে জড়িত। তাই গ্রামটি দারকি গ্রাম নামে পরিচিতি পেয়েছে। সেখানকার প্রায় প্রতিটি বাড়ি যেন দারকি তৈরির কারখানা। পরিবারের শিশু থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত সবার সারাদিন দারকি তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটে। বাঁশের তৈরি এ পণ্যটি কোথাও দারকি, কোথাও বাইর, আবার কোনো স্থানে চাঁই নামে পরিচিত। একেক এলাকায় মাছ ধরার দারকি ভিন্ন ভিন্ন নামে পরিচিত।
স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়ে থাকে এই দারকি । যদিও আধুনিক মাছ শিকারের বিভিন্ন যন্ত্র আবিষ্কারের কারণে বর্তমানে শিল্পটি নানা সমস্যায় জর্জরিত। একদিকে পুঁজি সংকট, অন্যদিকে বৃদ্ধি পেয়েছে চায়না রিং জালের ব্যবহার। ফলে এ শিল্প এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে।
দারকি তৈরির নারী কারিগর মনোয়ারা বেগম (৫৫) বলেন, পুরো দারকি একজন তৈরি করে না। একেকজন একেকটা ভাগ তৈরি করে। প্রথমে বাগান থেকে কাটা হয় শক্ত বাঁশ। তারপর ভালোভাবে কেটে টুকরো টুকরো করা হয়। টুকরোগুলোকে আবার ধারালো দা দিয়ে কাটা হয়। পরে আবার ছোট ছোট টুকরোকে চাহিদা অনুযায়ী বিভিন্ন আকার দেওয়া হয়। এক পর্যায়ে সবাই মিলে বসে পড়েন বাঁশের শলা নিয়ে। কেউ বাঁশের শলাকা তৈরিতে ব্যস্ত, কেউ আবার তা বুনন করতে ব্যস্ত। নিপুণ হাতে সুতোর গাঁথুনিতে ফুটে ওঠে আবহমান গ্রামবাংলার খাল-বিল, নদী-নালায় মাছ ধরার জন্য তৈরি বাঁশের শলা। বাঁশের ওই শলা দিয়ে তৈরি করা হয় চাঁই বা দারকি ।
প্রতিটি দারকি তৈরিতে খরচ হয় ১২০ টাকা, তা বাজারে বিক্রি হয় ২শ টাকায়। অগ্রহায়ণ, পৌষ, মাঘ ও ফাল্গুন মাসে মাছ ধরার মৌসুমে পণ্যটির ব্যাপক চাহিদা। এখানকার তৈরি দারকি ঢাকার বিক্রমপুর, কালিগঞ্জ, টঙ্গী ও জয়দেবপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়ে থাকে।
৬৫ বছর বয়সী বৃদ্ধ ময়নাল হোসেন বলেন, এখানে প্রত্যেক পরিবারের প্রতিটি সদস্য দারকি কারিগর। জন্মের পর থেকে মা-বাবার দারকি তৈরি করা দেখে ৪-৫ বছর বয়সে দারকির কারিগর হয়ে ওঠে এখানকার শিশুরা। আমিও ৫ বছর বয়সে বাবা-মার কাছে দারকি বানানো শিখেছি। ৬০ বছর ধরে দারকি তৈরি করে আসছি। খরচ বাদ দিয়ে যে কয় টাকা লাভ হয় তা দিয়ে সংসার চলে না। কী করব, অন্য কিছু তো শিখিনাই। শত অভাবের পরও বাপ-দাদার পেশাটি আঁকড়ে ধরে আছি।
কথা হয় বাচ্চু শেখ (৬২) নামে দারকি কারিগরের সঙ্গে। তিনি বলেন, সুদে ঋণ নিয়ে পুঁজি খাটিয়ে নিজে ও কারিগর দিয়ে দারকি তৈরি করেছি। বন্যার পানি খাল বিলে না আসায় দারকি বিক্রি হয়নি। বিক্রি না হওয়া তৈরিকৃত দারকি ঘরে স্তূপ আকারে পড়ে আছে। বিক্রি করে লাভের মুখ না দেখলেও সুদের টাকা গুনতে হচ্ছে। একদিকে সুদের টাকার চাপ, অন্যদিকে সংসার চালানো নিয়ে খুবই হিমশিমের মধ্যে আছি।
ছমিরন বেগম (৪৫) বলেন, ঘরে প্রচুর দারকি মজুদ রয়েছে। দাদন ব্যবসায়ীর সুদের টাকা পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি। বাঁশজাত এ শিল্পটি পুঁজির অভাবে ঋনের ফাঁদে পড়ে লাভের অংশ থেকে দাদনের সুদ গুনতে হয়। মাস শেষে কানাকড়িও হাতে থাকে না।
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েছে ক্ষুদ্র কুটির শিল্পটি। এদিকে চায়না রিং জালের ব্যবহার রোধসহ সব ধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সিরাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, দারকি তৈরির কারিগরদের বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণসহ প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।