
মধুমতি নদী। ছবি: সংগৃহীত
‘নদের চাঁদ’ নামটি লোকগল্প এবং কিংবদন্তির এক বিশেষ চরিত্র, যার পরিচয় আমরা পাই বাংলা সাহিত্য ও লোকজ সংস্কৃতিতে। এটি এমন এক রূপকথা যা যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে ঘুরেছে এবং সময়ের সঙ্গে নতুন রূপ পেয়েছে।
নদের চাঁদ নামে এক ব্যক্তি কীভাবে মানুষ থেকে কুমির হয়ে গেলেন- এই অদ্ভুত ও রহস্যময় কাহিনি মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। এই কিংবদন্তির কাহিনি আজও এলাকার মানুষের মুখে মুখে। নদের চাঁদের এই কাহিনি নিয়ে তৈরি হয়েছে নানা যাত্রা, নাটক এমনকি সিনেমা। তার নামে রয়েছে পুরো একটি মৌজা, গ্রাম, বাজার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
অনেক দিন আগের কথা। মধুমতি নদীর তীরবর্তী একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নদের চাঁদ। অতি সাধারণ পরিবারে জন্ম নেওয়া নদের চাঁদ ছিলেন বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন তার বাবা গদাধর। নদের চাঁদের জন্মের আগেই তার বাবা পদ্মায় মাছ ধরতে গিয়ে মারা যান। সন্তান বুকে নিয়ে দিন কাটে মায়ের। একসময় যৌবনে পা দেওয়া নদের চাঁদকে বাবার মতো মাছ ধরতে নদীতে যেতে দিতে চাননি মা। চেয়েছিলেন ছেলে বিয়ে করে সংসারী হোক, কৃষি কাজ করুক। কিন্তু সংসার বিবাগি নদের চাঁদের ঘরে মন বসে না। গভীর রাতে কাউকে কিছু না বলে নদের চাঁদ বেরিয়ে পড়েন অজানার পথে। এরপর কেটে যায় ১০টি বছর। দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফিরে আসেন নদের চাঁদ। তত দিনে তার মা বৃদ্ধ হয়ে যান। নদের মা এবার তাকে বিয়ে দেন। বউয়ের ভালোবাসা তাকে ঘরে আটকে রাখল। এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল সুখ ও আনন্দে।
একসময় দীর্ঘ ১০ বছরের অন্তর্ধানের রহস্য খুলে বলেন স্ত্রী সরলার কাছে। এত বছর কামরূপে (আসাম) এক নারীর কাছে জাদু বিদ্যা শেখেন। এই জাদুর বলে কুমির হতে পারেন বলে জানান স্ত্রীকে। এমন কথা শুনে স্ত্রীর শখ জাগে মনে। স্বামীকে কুমির হতে দেখবেন বলে বায়না ধরেন সরলা। স্ত্রীর শখ পূরণের জন্য গভীর রাতে দুটি পাত্রের পানিতে মন্ত্র পড়ে ফুঁ দেন নদের চাঁদ। সেই সঙ্গে স্ত্রী সরলাকে বলেন, একটি পাত্রের পানি গায়ে ছিটিয়ে দিলে কুমির হবে, অন্য পাত্রের পানি ছিটালে আবার মানুষ হবেন তিনি। এরপর এক পাত্রের পানি শরীরে ছিটিয়ে কুমির হয়ে যায় নদের চাঁদ। স্বামীকে কুমির হতে দেখে ভয় পেয়ে যান স্ত্রী সরলা। এ সময় সরলার পায়ের ধাক্কা লেগে অন্য পাত্রের পানি মাটিতে পড়ে যায়। স্বামীর কুমির হওয়ার বিষয়টি শাশুড়িকে জানান পুত্রবধূ। মা এসে দেখেন কুমির হয়ে গড়াগড়ি দিচ্ছে ছেলে। স্ত্রী সরলার দিকে তাকিয়ে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে চাঁদ। ঘটনার তিন দিন পর কুমির নদের চাঁদ মধুমতি নদীর পানিতে নেমে পড়ে। প্রতিদিন নদের মা নদীর ঘাটে বসে চোখের জল ফেলেন। কয়েক দিন পর কামরূপ থেকে নদের চাঁদের নারী উস্তাদকে খবর দিয়ে আনা হলো।
তিনি মধুমতি নদীর পাড়ে এসে নদের চাঁদ বলে ডাক দিলেন। তখন কুমির নদের চাঁদ মুখে ইলিশ মাছ নিয়ে উঠে এলো ডাঙায়। এ অবস্থা দেখে নারী উস্তাদ জানিয়ে দিলেন, ‘নদের চাঁদকে আর মানুষ করা যাবে না। কারণ ইতোমধ্যে আহার করে ফেলেছে কুমির নদের চাঁদ।’
এরপর মা ডাকলেই কুমির নদের চাঁদ ঘাটে চলে আসত। মায়ের হাতের খাবার খেয়ে আবার নদীতে ফিরে যেত। কিছুদিন পর নদী দিয়ে একদল বণিক জাহাজযোগে যাওয়ার সময় চরে বিরাট একটি কুমির দেখতে পান। তারা কুমিরটি মেরে ফেলেন। পরে জানাজানি হলে লোকজন মৃত কুমিরটি উদ্ধার করে সনাতন রীতি অনুযায়ী সৎকার করেন।
স্ত্রীর শখ পূরণে নদের চাঁদের কুমির হওয়ার বিষয়টি আজও মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার মানুষের মুখে মুখে। মহম্মদপুর উপজেলা সদর থেকে একটু দূরে মধুমতি নদীর তীরে ‘নদের চাঁদ ঘাটটি’ এর জন্যই সবার কাছে পরিচিত। একসময় এই ঘাটে স্টিমার ভিড়ত। ঘাটের পাশেই পাঁচুড়িয়া নামের একটি গ্রাম ছিল। পরে এটি ‘নদের চাঁদ’ গ্রাম নামে পরিচিতি পায়। ওই গ্রামের পর এখানে একটি ‘নদের চাঁদ’ বাজার ও ‘নদের চাঁদ’ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। এমন কাহিনির জন্য দূর-দূরান্ত থেকে অনেক মানুষ ‘নদের চাঁদ ঘাট’ দেখতে আসেন।