
সবজির বীজ বিতরণ করছেন বাদশা আলম। ছবি: পাবনা প্রতিনিধি
ভালো উদ্যোগ নিতে অর্থ-বিত্ত নয়, প্রয়োজন মানসিকতার। তেমনই একজন হলেন পাবনার বেড়া উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামের তাঁত-শ্রমিক বাদশা আলম ওরফে সাইকেল বাদশা। নিজের সম্বল একমাত্র বাইসাইকেলটি নিয়ে গ্রামের পথে প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে বিনামূল্যে শাকসবজির বীজ বিতরণ এবং সমাজ সচেতনতামূলক কাজ করছেন তিনি। পাবনা সদর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে বেড়া উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের বাদশার পেশা তাঁত বোনা। দিন-রাত হাড়ভাঙা খাটুনির পর মানুষটি সপ্তাহে ফুরসত পান মাত্র এক দিন। সেই দিনটিও নিজের বা পরিবারের জন্য না রেখে তিনি কাজে লাগান পরের জন্য।
গ্রামে ঘুরে ঘুরে বিনামূল্যে বিতরণ করেন সবজির বীজ। মানুষকে সচেতন করেন বাল্যবিয়ে, যৌতুকসহ সামাজিক নানা সমস্যা নিয়ে। তিনি বিনা স্বার্থে প্রায় এক যুগ ধরে এই সেবা দিচ্ছেন। সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়ান বলেই তার নাম হয়েছে ‘সাইকেল বাদশা’। বেড়া উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের আব্দুল বাতেন মোল্লা আর মনোয়ারা খাতুনের পাঁচ ছেলে চার মেয়ের মধ্যে চতুর্থ সন্তান বাদশা। সপ্তাহের মঙ্গলবার তাঁত বন্ধ থাকায় তিনি তার প্রায় ভাঙা সাইকেলটি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন জগন্নাথপুর থেকে শুরু করে দূর-দূরান্তের গ্রামে।
গ্রামের কোনো বাড়ির পাশে পতিত জমি দেখলেই বাড়ির মালিককে ডেকে তাদেরকে সবজি চাষে উদ্বুদ্ধ করেন এবং বাড়ির মালিকদের বিনামূল্যে লাউ, বেগুন, শাক, শিমসহ বিভিন্ন সবজির বীজ বিতরণ করেন। কীভাবে বীজ রোপণ করতে হয় তা-ও শিখিয়ে দেন বাদশা। মাঝেমধ্যে নিজে গিয়ে ওই চারার যতœও করেন। আর এই ফল ও সবজি বাড়ির মালিকরা নিজে খান, প্রতিবেশীদের দেন এবং অনেকেই তা বাজারেও বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন।
এ বিষয়ে বাদশা সাম্প্রতিক দেশকালকে জানান, ছোটবেলায় তার মা মনোয়ারা খাতুনকে দেখেছেন প্রতিবেশীদেরকে সবজির বীজ বিতরণ করতে। সেই থেকে উৎসাহী হয়ে বড় হয়ে এখন তিনি নিজে দূরের মানুষদের মধ্যেও বিনামূল্যে সবজির বীজ বিতরণ করে আসছেন। বাকি জীবনে তিনি এই কাজ চালিয়ে যেতে চান। এর বাইরে নিজের খরচে বাল্যবিবাহ ও যৌতুকবিরোধী লিফলেট ছাপিয়ে বিভিন্ন এলাকায় বিতরণ করেন বাদশা। তার সাইকেলে একটি ব্যানার টাঙানো থাকে যেখানে বাল্যবিয়ে, যৌতুক ও মাদকবিরোধী বক্তব্য লেখা থাকে।
সমাজের জন্য এই চিন্তা বাদশার মনে কীভাবে এলো? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দেশে বাল্যবিয়ে বেড়ে গেছে। এজন্য তিনি বীজ বিতরণের পাশাপাশি বাল্যবিয়ে ও যৌতুকের বিষয়ে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন।
এই মানুষটির জীবন দর্শনে দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি আর দেশকে বদলে দেওয়ার বিষয়টি প্রাধান্য পায় সব সময়। এই কাজে মানুষও তাকে উৎসাহ দেয় এবং সেই উৎসাহে তিনিও আনন্দ বোধ করেন। যত দিন বেঁচে থাকবেন তত দিন এই কাজ করে যাওয়ার কথাও জানান তিনি।
বাদশা বলেন, ভালো কাজ করলে তা কখনও হারিয়ে যায় না। আর আমার এই কাজে যদি একজন মানুষও উপকার পায় তাহলেই আমি খুশি। তবে আমার দেওয়া বীজে অনেকেই শিম, লাউ, বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন।
বাদশার স্ত্রী মিনারা খাতুন জানান, বিয়ের পর প্রথম দিকে তার এই ধরনের কাজ করাকে পছন্দ হতো না। এ নিয়ে ঝগড়াও হয়েছে। তবে পরে বুঝতে পেরেছি মানুষের জীবনটা আসলে পরের জন্যই। আর এ কারণে স্বামীর এই কাজে এখন তিনি গর্ববোধ করেন। এখন এ ধরনের কাজ করাকে উৎসাহ দেন মিনারাও।