
পণ্যের মতো বিক্রি হয় শ্রম। ছবি: পিরোজপুর প্রতিনিধি
সবে ভোরের আলো ফুটেছে, বেশির ভাগ মানুষ তখনো ঘুমিয়ে, কিন্তু পিরোজপুরের নাজিরপুরের বৈঠাকাটা বাজার লোকজনের কোলাহলে সরগরম হয়ে উঠেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে সেখানে হাট বসেছে। তবে এই হাটে নেই কোনো পণ্য। এখানে পণ্যের মতো বিক্রি হয় শ্রম। বিভিন্ন এলাকা থেকে নিম্ন আয়ের মানুষ এই হাটে আসেন শ্রম বিক্রির জন্য। তাদের শ্রম বিক্রি হয় দিন, সপ্তাহ বা মাস চুক্তিতে। ভোর থেকেই মানুষের এই হাট বসে; বেচাকেনা চলে সকাল ৯টা পর্যন্ত। সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার দুই দিন বসে এ হাট।
প্রায় ১০০ মিটার এলাকাজুড়ে এই ‘মানুষের হাট’। শ্রমিকরা কাজের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত হয়ে খদ্দেরের জন্য অপেক্ষা করেন এখানে। খদ্দের এলে শ্রমিকরা জড়ো হন। আবার অনেক শ্রমিক কাজ নেবেন বলেও ডাকতে থাকেন।
শ্রম বিক্রি করতে আসা বেশিরভাগ শ্রমিকের বাড়ি পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট জেলায়। তাদের বেশির ভাগই কৃষি শ্রমিক, রাজমিস্ত্রি ও গৃহস্থালির কাজ করেন। ধান রোপণ ও কাটার সময় এই বাজারে প্রতিদিন পাঁচ হাজারের মতো শ্রমিক শ্রম বিক্রির জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। অন্য সময়ে দুই থেকে তিন হাজার। যাদের বেশির ভাগই কৃষিকাজ করেন বলে চিতলমারী থেকে আসা শ্রমিক জুলফিকার জানান।
বর্তমান সময়ে বেশির ভাগ শ্রমিক ভাসমান সবজির কান্দিতে কাজ করছেন জানিয়ে তিনি বলেন, দৈনিক ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায় বিক্রি হন শ্রমিকরা। আর দৈনিক ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা চুক্তিতে বিক্রি হন গৃহস্থালির শ্রমিকরা। মাসে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা চুক্তিতেও অনেকে কাজ করেন। কাজ হিসেবে চুক্তিভিত্তিক বেতন নেন কিছু শ্রমিক।
তিনি আরো বলেন, এলাকায় যে কাজ আছে তা দিয়ে সংসার চলে না। তাই এখানে এসেছি। যদিও প্রতিদিন কাজ পাই না, কোনো কোনো সপ্তাহে খালি হাতে ফিরতে হয়।
শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোরে হাটে এসেও সকাল ৯টার মধ্যে যারা শ্রম বিক্রি করতে পারেন না, তাদেরই ফিরতে হয় ‘শূন্য হাতে’। শ্রমিকদের কেউ কেউ আসেন দুই-এক মাসের জন্য। থাকার সুবিধা কিংবা ভালো কোনো কাজ পেলে থেকে যান বছরের পর বছর। আবার টানা কয়েক দিন কাজ না পেলে অনেকে এক হাট থেকে অন্য হাট পর্যন্ত অপেক্ষা করেন।
শ্রমিকরা হাটে আসার জন্য দলে দলে ছোটেন ছেঁড়া লুঙ্গি, শার্ট, টি-শার্ট ও পুরোনো প্যান্ট পরে; গলা ও কোমরে গামছা বাঁধা থাকে। পোশাক যেমনই হোক তাতে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই। সন্তান ও পরিবারের লোকজন নিয়ে বেঁচে থাকতে চায় কাজ করে। আর এই কাজ পেতেই ঘুম চোখ নিয়ে চলে তাদের লড়াই।
বাগেরহাট জেলার সোনাকুর গ্রামের নিজাম জানান, সংসারের চাকা ঘোরে মানুষের কাজ করে। মাসে সব মিলিয়ে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা রোজগার করেন। বলেন, বাড়িতে বাবা-মা, স্ত্রী, স্কুলে পড়া দুই ছেলেমেয়ে আছে। থাকা-খাওয়া ফ্রি হওয়ায় যা বেচে যায়, বাড়িতে পাঠাই। দিন ৫৫০ টাকা ধরে একজনের সঙ্গে যাব।
আমতলা গ্রামের সাইদুল শেখের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে কাজের আশায় এসেছেন। কোনো কোনো দিন কাজ পান, আবার কোনো দিন তাকেও খালি হাতে ফিরতে হয় বাড়িতে।
বেশির ভাগ শ্রমিক জানান, যারা কাজের জন্য নিয়ে যান, তারা লোক ভালো হলে থাকা-খাওয়ার অসুবিধা হয় না। আবার অনেকে আছেন, যারা আমাদের মানুষই মনে করেন না।
সবজি বাগানের কান্দির কাজের জন্য শ্রমিকের খোঁজে এসেছেন বিশারকান্দির সরকার বাড়ি এলাকার বিনয় সরকার। তিনি বলেন, শ্রমিক দরকার, তাই ভোরেই চলে এসেছি। স্থানীয় শ্রমিকদের থেকে অপেক্ষাকৃত কম মজুরিতে এখানে লোক পাওয়া যায়। তারা কাজেও বেশ আন্তরিক। তাই বেশির ভাগ মানুষই এখানে শ্রমিক নিতে আসেন।
বিলডুমরিয়া গ্রাম থেকে শ্রমিক কিনতে আসা আব্দুল লতিফ জানান, দুজন শ্রমিক দরকার, একজন পেয়েছি ৫৫০ টাকায় পুরো দিন। আরো একজনকে একই দাম বলছি, কিন্তু রাজি হচ্ছে না। গত বছর ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় শ্রমিক কিনেছি। এ বছর তাদের দাম বেশি।