
গাজীপুরের রাস্তায় আন্দোলনরত ছাত্ররা। ফাইল ছবি
৫ জুলাই জয়দেবপুর পৌর সুপারমার্কেটের সামনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থনে গাজীপুরে প্রথম প্রকাশ্য কর্মসূচি পালন করে গাজীপুর জেলা ছাত্র ইউনিয়ন। সেদিন কর্মসূচি শেষে মিছিল বের হলে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের গাজীপুর মহানগরের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোস্তাক আহমেদ কাজল একটি গাড়ি নিয়ে মিছিলের সামনে আসে এবং বারবার জিজ্ঞেস করতে থাকে, এই কারা তোমরা? বাড়ি কই তোমাদের? তখন আমাদের এক সহযোদ্ধা সাহসিকতার সঙ্গে জবাব দেয়, ‘এই শহরেই আমাদের বাড়ি’।
মিছিল এগিয়ে যেতে থাকে শিববাড়ী মোড়ের দিকে, সেখানে বিক্ষোভ সমাবেশ হয় সাধারণ শিক্ষার্থীদের। সমাবেশে বক্তব্যে বলি, ‘সংকট নিরসনের ব্যাপারে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকার আলোচনায় না বসে এবং সারা দেশের কোথাও যদি একটা লাঠির বাড়িও এই পেটোয়া পুলিশ বাহিনী দেয়, তাহলে ঢাকা-জয়দেবপুর রেললাইন বন্ধ করে দিয়ে সারা দেশের সঙ্গে রেল যোগাযোগ অচল করে দেব আমরা।’ উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করছিলেন আমাদের নিয়ে, ‘এই কয়টা মানুষ কী বলে এসব। পাগল হয়ে গিয়েছে।’
অতঃপর পরদিনও যখন সরকার আলোচনায় বসল না এবং বিভিন্ন শহরে আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ চড়াও হলো, প্রতিবাদে ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ৭ জুলাই ভারত অভিমুখে যাত্রা করা মৈত্রী এক্সপ্রেস জয়দেবপুর রেলস্টেশন থেকে দুই কিমি সামনে আটকে দিই আমরা। বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-জয়দেবপুর রেল যোগাযোগ। এই খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। ধীরে ধীরে নতুন নতুন নামে কর্মসূচি চলতে থাকে আন্দোলনকারীদের। ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচিতে গাজীপুরের সাধারণ ছাত্র-জনতা অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। স্বেচ্ছায় তারা দোকানপাট বন্ধ রাখে। ১৮ জুলাই আমরা গাজীপুরের শিক্ষার্থীরা প্রথম বড় মিছিল বের করি। মিছিলটি শিববাড়ী হয়ে ডুয়েট যাওয়ার পথে জয়দেবপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ছাত্রলীগের গুন্ডারা লাঠি এবং রামদা নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। সেদিন আমি আমার বা পায়ে কিছুটা আঘাতপ্রাপ্ত হই। সেখান থেকে কোনোভাবে কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে দৌড়ে গাজীপুর জেলা ছাত্রফ্রন্টের অফিসে এসে আশ্রয় নিই। সেদিন রাতেই ছাত্রলীগ-যুবলীগ যৌথ মিছিল করে জয়দেবপুরে। বিভিন্ন ইস্যুতে সরকারের সমালোচনা করে বক্তব্য দেওয়ায় আমার ওপর আগে থেকেই ক্ষোভ ছিল মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের। ১৮ জুলাই থেকেই আমার পালিয়ে বেড়ানো শুরু। সেই যে ঘর ছাড়লাম ৫ আগস্ট সরকার পতনের আগের দিন অব্দি নিজের বাড়িতে থাকতে পারিনি। এর ভেতর আমার বাড়িতে এসে আমাকে খুঁজে না পেয়ে আমার বাবাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ডিবি পুলিশ তাদের কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে। জয়দেবপুর শহরে আর আসতে পারি না তখন প্রাণ ভয়ে।
কাজী আজিমউদ্দিন কলেজে আমি পড়াশোনা করতাম, ক্যাম্পাসে আমাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হলো। আমি তখন ভাওয়াল গাজীপুরের এক গ্রামে আত্মগোপনে থাকি দিনের বেলা। ছাত্র ইউনিয়নের সহযোদ্ধাদের নিয়ে একটি গেরিলা বাহিনী গঠন করার চিন্তাভাবনাও এলো মাথায়। সারা দিন ভাওয়ালগড়ে বসে থাকি, রাতে জয়দেবপুর শহরে ফিরে আসি। বিভিন্ন মিটিং প্ল্যান শেষ করে আবার ফিরে যেতাম ভাওয়ালগড়ের সেই শালবনে ভোর হওয়ার আগেই। ততদিনে আমাকে দেখামাত্র গ্রেপ্তার করার নির্দেশ জারি হয়ে গেছে জননিরাপত্তা আইনে। এই খবর আমি জেনেছিলাম এক এনএসআই অফিসারের মাধ্যমে। কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা ছিল যে গ্রেপ্তার এড়িয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। একসময় আমাদের কাছে থাকা নগদ অর্থও ফুরিয়ে যায়। ভিপিএন কানেক্ট করে একটা মেসেজ লিখে বিশ্বস্ত কয়েকজনকে সেন্ড করি একটি দোকানের বিকাশ নম্বর দিয়ে। আশ্চর্যজনকভাবে প্রায় সবাই রেসপন্স করে। তারা আমাদের কিছু নগদ অর্থ পাঠান। তারা হলেন উদ্যোক্তা মুসাফির ইমরান, ডা. মনিরুজ্জামান, আমার কলেজের একজন শিক্ষক, আমার তিন বান্ধবী এবং আমার ছোট খালামণি। সেই টাকার পরিমাণ ছিল ছয় হাজার ২৩০ টাকা। সেই টাকা থেকে বেঁচে যাওয়া ৪০ টাকা আমি এখনো স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছি।
তখন আন্দোলনের সময় ভিড়ে মিশে আন্দোলন সংগঠিত করে আবার লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যেতাম। এর ভেতর কারফিউ জারি হলো। আমাদের জীবনে এলো ২৬ জুলাই, এক ভয়াবহ শুক্রবার। জুমার নামাজের পরে সিদ্ধান্ত হলো শিববাড়ী মোড়ে আন্দোলনকারীরা জমায়েত হবে। আমি আর ছাত্র ইউনিয়নের তন্ময় শিববাড়ী এসে দেখি পুলিশ যুদ্ধসাজে সজ্জিত। আমি আর তন্ময় পুলিশ যে পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেদিক থেকে শিক্ষার্থীদের দিকে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে একটা ভোঁ দৌড় দিই। আর তখনই হঠাৎ গুলি, টিয়ার শেল ছোড়া শুরু করে পুলিশ। শিক্ষার্থীরা উল্টোদিকে দৌড় শুরু করে। তখন আমরা কজন চিৎকার করে সবাইকে ডাকা শুরু করলাম, সবাই দাঁড়াও! রুখে দিতে হবে এদের! ভয় পেয়ো না! তখন সবাই ধীরে ধীরে প্রতিরোধ গড়ে তোলা শুরু করল। আশপাশের এলাকার মানুষ ছুটে আসে শিক্ষার্থীদের পাশে। তারা বিভিন্ন বাসার ছাদ, দোকানপাট থেকে নতুন আসবাবপত্রও রাস্তায় ফেলে দিয়ে আগুন ধরানোর জন্য বলে। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়ার মধ্যে আমার জুতা হারিয়ে ফেলি। রাস্তায় ধরানো আগুনের কয়লার টুকরো পায়ে লাগছিল। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমার মতোই কেউ এক জোড়া জুতা রাস্তায় ফেলে গেছে, সেটাই পরে নিলাম। টিয়ার গ্যাসে আমার বুক-পেট জ্বলে যাচ্ছিল। একসময় আমি হাঁটার শক্তি হারিয়ে ফেলি এবং জালাল মার্কেটের রাস্তার মুখে অনেকটা অচেতন হয়ে বসে পড়ি। তখন আমার মুখে পেস্ট মাখিয়ে দিয়েছিল কিছু বোন। পরে জানতে পেরেছিলাম, ওরা আমার কলেজের সহপাঠী। কিছুটা সুস্থ হয়ে আবার এগিয়ে যাই সামনের দিকে। পেছন দিক থেকে ছাত্রলীগ আক্রমণ করে। আমরা একসময় দৌড়ে আমাদের এক বড় বোনের বাসায় আশ্রয় নিই। এর ভেতর একদিন ছাত্রলীগ আমাকে তুলে নিয়ে যায় এবং জোরপূর্বক ফেসবুকে আন্দোলনের বিরুদ্ধে পোস্ট করায়। পরে সেখান থেকে বের হয়ে আমি পোস্টটি ডিলিট করে দিই। এভাবে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকি।
৪ আগস্ট আমরা চৌরাস্তা অভিমুখে যাত্রা করি প্রচণ্ড বৃষ্টির মাঝে। ফেরার পথে শিববাড়ী মোড়ে তিনজনকে কুপিয়ে জখম করে আওয়ামী লীগের গুন্ডারা। আমরা তারপর আওয়ামী লীগ অফিস অভিমুখে যাত্রা করি গুন্ডাদের খুঁজতে। মিছিলটি যখন রাজবাড়ী ঢালে গিয়ে পৌঁছায়, পুলিশের পাশে দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুন্ডারা প্রকাশ্যে গুলি করে মিছিলের ওপর। যারা গুলি চালিয়েছিল তাদের চেহারা আমার এখনো পরিষ্কার মনে আছে। তারা হলো কাজী আজিমউদ্দিন কলেজ শাখা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক এস এম মেরাজুর রহমান স্বাধীন, মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মোস্তাক আহমেদ কাজল, মাসুদ রানা এরশাদ, ছাত্রলীগ কর্মী রিফাত আহমেদ, শামসুল ইসলাম অনিকসহ অনেকেই। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, সামনে ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুন্ডারা, পেছনে পেটোয়া পুলিশ বাহিনী। মাঝে কিছু নারী শিক্ষার্থীসহ আমরা আটকে পড়ি। খবর পেয়ে সেনাবাহিনীর একটি টিম চলে আসে শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে। সেদিন কিছু রাবার বুলেট লাগে আমার পায়ে। পরদিন সকালে খবর এলো স্বৈরাচার হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। এক দৌড়ে শহরে ছুটে আসি। রাস্তায় মানুষজন খুশিতে চিৎকার করে আমাদের জড়িয়ে ধরছিল, মিষ্টি খাওয়াচ্ছিল। সেই অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। সেদিন সন্ধ্যায় ১৮ দিন পরে বাড়ি ফিরে এলাম। রাস্তার মুখে দেখি আমার মা এবং বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদলেন। মাকে বললাম কাঁদছ কেন? আমরা তো বিজয়ী!
সেই রাতেই আবার বেরিয়ে পড়তে হলো গাজীপুরে সাম্প্রদায়িক হামলা প্রতিরোধ করতে। আন্দোলনকারীদের নিয়ে গড়ে তুললাম ‘গাজীপুর পুনর্গঠন’ নামক একটি প্ল্যাটফর্ম। সেখানে ১০ হাজার শিক্ষার্থী দীর্ঘ তিন মাস গাজীপুরে সংস্কারমূলক কাজ করে গেছে। পরের কথা তো সবাই জানে, ফিরে এলাম নিজ ছাত্রসংগঠনের কাজে। আমি সেই জুতা জোড়া এখনো রেখে দিয়েছি। এগুলো জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের জাদুঘরে জমা দেওয়ার ইচ্ছা রয়েছে।