Logo
×

Follow Us

জেলার খবর

মহাকাব্যের মহানায়ক আবু সাঈদ

Icon

মোছা. সুমাইয়া খাতুন

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১১:৩৩

মহাকাব্যের মহানায়ক আবু সাঈদ

পুলিশের গুলির আঘাতে কিছুক্ষণ পরই পড়ে যান আবু সাঈদ। ফাইল ছবি

২০২৪-এর অভ্যুত্থানের অন্যতম বীর শহীদ আমাদের বন্ধু আবু সাঈদ। এমন সাধারণ একজন শিক্ষার্থীর বিশ্বের দরবারে সমাদৃত হওয়ার এই গল্পটা মোটেও আনন্দের নয়, বরং অত্যন্ত বিষাদময় ও মর্মপীড়াদায়ক। 

২০০১ সালে রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার বাবনপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করা আবু সাঈদ ছিলেন ৯ ভাই-বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ, ছিলেন সবার আদরের। পিতা মকবুল হোসেন পেশায় একজন দিনমজুর এবং মা মনোয়ারা বেগম একজন গৃহিণী। ছেলেবেলা থেকেই আবু সাঈদ অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। পিএসসি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ+ পেয়ে উত্তীর্ণ হন। তারপর রংপুর সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ২০২০ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হন। আবু সাইদ তার পরিবাবের প্রথম সদস্য, যে উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। তার জীবনের গল্পটা আমাদের মতো সাধারণ হতে পারত। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অন্য রকমই ইচ্ছা ছিল।

নম্র, ভদ্র, সাদাসিধে ছেলেটি ছিল অত্যন্ত সাহসী ও স্পষ্টভাষী। ৫ জুলাই থেকে শুরু হওয়া কোটা সংস্কার আন্দোলনে আবু সাঈদ ছিল আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক। আন্দোলনটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে দেশের বহু শিক্ষাঙ্গন অচল হয়ে পড়ে। আন্দোলন চলাকালীন ক্যাম্পাসের তথাকথিত কিছু ছাত্রলীগ নেতা আবু সাঈদকে আন্দোলন থামানোর হুমকি দেয়। এমনকি তার গায়ে হাতও তোলে। কিন্তু আবু সাঈদ দমে যাওয়ার পাত্র ছিল না, সে পুরোদমে আন্দোলন চালিয়ে যায়। 

দেখতে দেখতে চলে আসে সেই ভয়াবহ ১৬ জুলাই। বাংলাদেশের ইতিহাসের আর এক কলঙ্কময় দিন। যে দিন আমরা প্রত্যক্ষ করি দেশের প্রতি ভালোবাসার তীব্রতা, পাশাপাশি রক্ষকের ভক্ষক রূপ। ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি মিছিল ১ নম্বর গেটের সামনে গেলে পুলিশ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা প্রধান ফটক আটকে তাদের প্রবেশে বাধা দেয় এবং ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা করে। পুলিশ ও ছাত্রলীগ হামলা করছিল ক্যাম্পাসের ভেতর থেকে এবং আমরা পার্কের মোড় এলাকায় অবস্থান করেছিলাম। আন্দোলন দমাতে পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও লাঠিপেটা শুরু করে। তখনো আবু সাইদ মিছিলের নেতৃত্বে ছিল। এক পর্যায়ে পুলিশ বুলেট ছোড়া শুরু করলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা মুহূর্তেই ছত্রভঙ্গ হয়ে পার্কের মোড় অভিমুখে গমন করে। কিন্তু একমাত্র আবু সাঈদ পিছু হটেনি। হাতে একটি মাত্র লাঠি নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল। আমরা বাকিরা সেদিন এমন অদম্য সাহসী হতে পারিনি।

আবু সাঈদ সেদিন দুই হাত প্রসারিত করে বুক পেতে দিয়েছিল পুলিশের বন্দুকের সামনে। প্রতিবাদ জানিয়েছিল স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে এবং তুলে ধরেছিল ছাত্র-জনতার স্পিরিট। হঠাৎ বেশ কয়েকটি রাবার বুলেট এসে লাগে আবু সাঈদের শরীরে।

প্রশাসনের এমন অনাকাঙ্ক্ষিত নির্মমতা সে যেন মেনে নিতে পারছে না। আমরাও  হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। শরীরের ভারসাম্য হারানোর উপক্রম হলেও আবারও বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে আবু সাঈদ। সবাই মিলে ডেকেও তাকে তার স্থান থেকে সরাতে পারিনি। পরবর্তী সময়ে যখন আবার গুলি লাগে, তখন আর উঠতে পারেনি, রাস্তার মধ্যে বসে পড়ে। হয়তো তার মন চেয়েছিল উঠে দাঁড়াতে, কিন্তু এবারে শরীর আর সায় দেয়নি। 

তখন কয়েকজন শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে ফিরিয়ে আনতে যায়, ততক্ষণে সে অচেতন হয়ে যায়। কিন্তু তখনো ক্যাম্পাস কর্তৃপক্ষ অ্যাম্বুলেন্স দেয়নি আমার বন্ধুকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য। রিকশায় করে রংপুর মেডিক্যালে যাওয়ার পথেই আনুমানিক বিকেল ৩টা ৩৫ মিনিটে আমার বন্ধু তার শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করে। এক মুহূর্তের জন্য সংবাদটা শোনার পর আমরা স্তব্ধ হয়ে যাই। এমন ছেড়ে যাওয়া কোনোভাবেই মেনে নিতে পারিনি আমরা। পরক্ষণেই সবার অন্তরে জ্বলে ওঠে আগুনের স্ফুলিঙ্গ। মুহূর্তেই আবু সাঈদ হয়ে ওঠে দেশের সব মায়ের সন্তান এবং সব শিক্ষার্থীর ভাই। তাকে হারানোর বেদনায় উত্তাল হয়ে ওঠে রংপুরসহ পুরো বাংলাদেশ। আবু সাঈদের মৃত্যু আন্দোলনে যে মাত্রা যোগ করে তার অবধারিত পরিণতিতে ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতন হয়। আমরা ঠিকই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি পেলাম, কিন্তু বন্ধুর জীবনের বিনিময়ে।

বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা যেমন ৭১ ভুলিনি, তেমনিভাবে ২৪-ও ভুলবো না- লালন করব আমাদের স্মৃতিতে।

মোছা. সুমাইয়া খাতুন: ১২তম ব্যাচ, পরিসংখ্যান বিভাগ 
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫