-copy-679f068ad7737.jpg)
জনসমুদ্রে উত্তাল খুলনা শহর। ফাইল ছবি
৪ জুলাই প্রথমবারের মতো রাজপথে নামেন খুলনার শিক্ষার্থীরা। কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের পরিপত্র বহাল রাখাসহ চার দফা দাবিতে খুলনা শহরের জিরো পয়েন্ট মোড় অবরোধ করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
৫ তারিখ দ্বিতীয় দিনের মতো খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জিরো পয়েন্ট অবরোধ করেন। এদিন তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। একইভাবে ৬ জুলাই বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধ করেন ছাত্রছাত্রীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচিতে ১০ জুলাই খুলনায় রাজপথ ও রেলপথ অবরোধ করেন সরকারি ব্রজলাল কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা। অন্যদিকে রূপসা নদীর খান জাহান আলী সেতু অবরোধ করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেন। ১৬ জুলাই আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে খুলনা। পরদিন ১৭ জুলাই খুলনার তিনটি পয়েন্টে মহাসড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা। একই দিন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি সিন্ডিকেট সভায় সব শিক্ষা কার্যক্রম পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ছাত্রদের বিকেল ৫টার মধ্যে এবং ছাত্রীদের পরদিন সকাল সাড়ে ১০টার মধ্যে হল ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেদিন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ও বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৮ জুলাই নগরীতে কঠোর অবস্থান নেয় পুলিশ, মোতায়েন করা হয় বিজিবি। কমপ্লিট শাটডাউনের অংশ হিসেবে খুলনার শিববাড়ীর মোড়ে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক হাজার শিক্ষার্থী অবস্থান নেন।
এরপর কারফিউ জারি হলে আন্দোলনে কিছুটা ভাটা পড়ে। ৩০ জুলাই আবারও খুলনার রাজপথে নামে শিক্ষার্থীরা। এদিন রাত ১১টার দিকে খুলনা সার্কিট হাউসে মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক, খুলনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য এস এম কামাল, খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপপুলিশ কমিশনার রকিবুল হাসান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজমুল হুসাইন খান, খুলনা মহানগর যুবলীগের সভাপতি শফিকুর রহমান পলাশ, সাধারণ সম্পাদক শেখ শাহজালাল হোসেন সুজন, খুলনা মহানগর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান রাসেল প্রমুখ শিক্ষার্থীদের ১১ জন প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসে আন্দোলনের কর্মসূচি প্রত্যাহার করতে চাপ প্রয়োগ করেন। চাপে পড়ে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও আরেকটি অংশ সে ঘোষণা প্রত্যাখ্যান করে।
৩১ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচি পালনকালে শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এতে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী আহত হন। ছাত্রীসহ ৩৫ জনকে পুলিশ আটক করে। প্রতিবাদে ১ আগস্ট মানববন্ধন করেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। মাথায় লাল কাপড় বেঁধে মৌন মিছিল করেন তারা।
২ আগস্ট শিক্ষার্থী ও পুলিশের মধ্যে তিন দফা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। জিরো পয়েন্ট, গল্লামারী মোড় এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ৩০ জন আন্দোলনকারী আহত হন। পরদিন ৩ আগস্ট খুলনার গুরুত্বপূর্ণ মোড় কিংবা সড়কে পুলিশের কোনো উপস্থিতি দেখা যায়নি। ৪ আগস্ট সকালেই পুরো খুলনা শহরের নিয়ন্ত্রণ নেয় আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা। রাজপথে ঢল নামে লাখো জনতার।
৪ আগস্ট, দিনটি ছিল রবিবার। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা অসহযোগ কর্মসূচির সমর্থনে খুলনার রাজপথে ছাত্র-জনতার ঢল নেমে আসে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি বিএল কলেজসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষার্থীরা খণ্ডখণ্ড বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সকাল ১০টা থেকে শিববাড়ী মোড়ে জড়ো হতে থাকেন। তাদের সঙ্গে যোগ দেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। দুপুর ১২টার দিকে আন্দোলনকারীরা পিকচার প্যালেস মোড় থেকে মিছিল বের করার সময় আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা প্রকাশ্যে পিস্তল থেকে গুলি করতে থাকেন। একসময় আন্দোলনকারীরা একত্রিত হয়ে ধাওয়া দিলে তারা পিছু হটে যান।
পরদিন ৫ আগস্ট সকাল থেকেই নগরীর শিববাড়ী মোড়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারীরা। গত দিনের মতোই স্লোগানে উত্তাল ছিল নগরী। দুপুরে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার খবরে সারা দেশের মতো খুলনার রাজপথেও শুরু হয় আনন্দ-উল্লাস আর বিজয় মিছিল। শহরের প্রতিটি অলিগলি উপচে পড়ে আনন্দ মিছিলে। পরে শিববাড়ী মোড়ে এসে মিশে যায় সব মিছিল।