Logo
×

Follow Us

জেলার খবর

‘জুলাই অভ্যুত্থান’ মানুষের লড়াই-সংগ্রামের উজ্জ্বল সংযোজন

Icon

ইমন সৈয়দ

প্রকাশ: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:২৬

‘জুলাই অভ্যুত্থান’ মানুষের লড়াই-সংগ্রামের উজ্জ্বল সংযোজন

বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার জোয়ার চট্টগ্রামে। ফাইল ছবি

২০২৪ সালে জুলাই আন্দোলন কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হলেও নানা ঘটনার চড়াই-উতরাইয়ে ৯ দফা দাবিতে আন্দোলন চূড়ান্ত মাত্রা লাভ করে এবং এক পর্যায়ে একদফা ঘোষণা হয়ে ৫ আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ দীর্ঘ ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসন থেকে মুক্তি লাভ করে। 

জুনের শুরু থেকে কয়েকবার আন্দোলন অল্প মাত্রায় শুরু হলেও জুলাইয়ের শুরু থেকে পুরোদমে আন্দোলন চলতে থাকে। 

প্রথমদিকে এই আন্দোলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যুক্ত থাকলেও খুব দ্রুতই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় জুলাইয়ের শুরুতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনে আমি যুক্ত হই জুলাইয়ের ৯ তারিখ থেকে। আমরা ধারাবাহিকভাবে চট্টগ্রামে বাংলা ব্লকেডসহ নানা কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে আমাদের আন্দোলনে শহরের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি কলেজ এবং প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়ে যায়। সারা দেশে কর্মসূচি পালনকালে ছাত্রলীগ ও পুলিশের নেতৃত্বে অল্পবিস্তর হামলা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলে ইঙ্গিত করার প্রতিবাদে সারা দেশে বিক্ষোভ সমাবেশ পালন উপলক্ষে চট্টগ্রামে জুলাইয়ের ১৫ তারিখ ষোলশহরে সবাই সমবেত হয়। এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শহরগামী শাটল ট্রেন ষোলশহর এসে পৌঁছানোর কথা থাকলেও আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বাঁধা দিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ সেই ট্রেন আটকে দেয়। বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করে। এদিকে ষোলশহরে শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে স্লোগান দেয়। সবার মধ্যে ভীতসন্ত্রস্ত অবস্থা- কোনো মাইক নেই, নেতৃত্ব নাই। সেই মুহূর্তে আমি আমার কয়েকজন বন্ধুর কাছ থেকে তাৎক্ষণিক ৫০ থেকে ১০০ টাকা করে তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই এনাম আর আবিদকে মাইক আনতে ২ নম্বর গেটে পাঠাই। এই সময়ের মধ্যে জটলার ভেতর গিয়ে আমরা স্লোগান দিয়ে শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাই। শহরগামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেন আটকে দেওয়ার খবর আমাদের কাছে পৌঁছাতেই প্রতিবাদে সবাই ফেটে পড়ে এবং প্ল্যাটফর্মে থাকা কাঠের পাত দিয়ে রেললাইন ব্লক করে দিই। এদিকে এনাম আবিদকে ফোনের ওপর ফোন দিয়ে যাচ্ছি রেসপন্স না পেয়ে শঙ্কিত হই। কয়েকজন মিলে ষোলশহর প্রবেশমুখে গিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করি। পুলিশ সাঁজোয়া যান ও বহর নিয়ে পুরোদমে প্রস্তুত। তার মধ্যেই মহানগরের কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে ওই জায়গায় উপস্থিতি দেখি। তখনই বুঝে গিয়েছিলাম যে ছাত্রলীগ আজকে ষোলশহরে আমাদের ওপর হামলা করবেই। বিলম্ব হলেও ছোট ভাই এনাম আর আবিদ পথিমধ্যে নানা বাধা পেরিয়ে ষোলশহরে রিকশা করে মাইক নিয়ে এসে পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা কয়েকজন ধরাধরি করে প্ল্যাটফর্মের ওপর রিকশা তুলি। আমি মাইক হাতে নিই।

প্রায় পাঁচ মিনিটের মতো বক্তব্য দিই। বক্তব্যে আগের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শিক্ষার্থীদের রাজাকার ইঙ্গিত নিয়ে প্রতিবাদ জানাই। ছাত্রলীগের অবস্থান সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক করি এবং একই সঙ্গে ভয় না পেয়ে ১০ থেকে ২০ জন করে দল বেঁধে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ছাত্রলীগকে প্রতিহত করার আহ্বান জানাই। (এর আগে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ভ্যাট-ট্যাক্সবিরোধী আন্দোলন, ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনসহ নানা অধিকারভিত্তিক আন্দোলনে যতবারই শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমেছে ততবারই ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের হামলা ও নির্যাতনের স্বীকার হতে হয়েছিল। এই অভিজ্ঞতার আলোকে শুরু থেকে এবারের আন্দোলনে ব্যক্তিগতভাবে আমার পাল্টা প্রতিরোধের বাসনা ছিল এবং শেষমেশ তা কার্যকর করতে সফল হই। এটা করা না গেলে আমরা আগের মতো এবারও ব্যর্থ হতাম।) বক্তব্যে সেই লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করি। আশ্চর্যজনকভাবে আমার বক্তব্যের বড়জোর দুই মিনিট পরপরই ছাত্রলীগ লাঠিসোঁটা হাতে ফাঁকা গুলি ও ইটপাটকেল ছুড়তে ছুড়তে ষোলশহরে প্রবেশ করলে আমরা একটু পেছনে সরে গিয়ে অবস্থান নিয়ে তাৎক্ষণিক রেললাইনের পাথর ছুড়ে সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। আমাদের প্রতিরোধের সম্মুখ সারিতে চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ ওয়াসিমও ছিল। শিক্ষার্থীদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে ছাত্রলীগ ষোলশহর থেকে পালাতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশে জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্রলীগকে প্রথম প্রকাশ্যে প্রতিরোধের ঘোষণা ষোলশহর থেকেই হয়েছিল। ওই দিন সারা দেশে ছাত্রলীগ আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করতে পারলেও একমাত্র ষোলশহর থেকেই  ছাত্রলীগ আমাদের সম্মিলিত প্রতিরোধের মুখে মার খেয়ে পালাতে বাধ্য হয়।  এরপর থেকে সারা দেশে প্রতিবারই ছাত্রলীগ ও পুলিশের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ১৬ জুলাই মুরাদপুর কর্মসূচি পালনকালে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের পরস্পর ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। ওই দিন ওয়াসিম, শান্ত ও কাঠমিস্ত্রি ফারুক এই তিনজন ছাত্রলীগ ও পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। ওয়াসিম ছিল চট্টগ্রামের প্রথম শহীদ। ১৭ জুলাই লালদীঘিতে গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি পালিত হয়। এরপরের দিন ১৮ জুলাই, প্রথমে শিক্ষার্থীরা নতুন ব্রিজে অবস্থান নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশ বিজিবি ও ছাত্রলীগের হামলার কারণে ছত্রখান হয়ে যায়। এক পর্যায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা পুনরায় নগরীর বহদ্দারহাটে অবস্থান নিলে পুলিশ সেখানেও টিয়ার গ্যাস, রাবার বুলেট, মারণাস্ত্র দিয়ে হামলা করে। ওই দিন পুলিশের গুলিতে তানভীর ও সাইমুন শহীদ হন। ফরহাদ ও হৃদয় চন্দ্র তড়ুয়াও ওই দিন গুলিবিদ্ধ হন। পরবর্তী সময়ে এই দুজনই শহীদ হন। এর পরের দিন থেকে ইন্টারনেট শাটডাউন করে দেওয়া হয়। ১৯ জুলাই ছিল ছিল গায়েবানা জানাজা কর্মসূচি। কিন্তু ইন্টারনেট শাটডাউনের কারণে আমাদের যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমার বন্ধু আরিফ ও আজাদ নানাভাবে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ফোনে মেসেজ করে জানিয়ে দেয় যে পরের দিন শুক্রবার জুমার নামাজকে কেন্দ্র করে আন্দরকিল্লা মসজিদে সমবেত হতে পারি। ১৯ জুলাই আমরা আন্দরকিল্লা মসজিদ গিয়ে সমবেত হই। আমাদের অনেক নারী শিক্ষার্থী ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ভাই-বোনদের মসজিদের নিচে অপেক্ষারত দেখতে পেলাম। চারদিকে পুলিশ প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি। আমরা পুলিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জুমার নামাজের পরপরই স্লোগান ও মিছিল সহকারে লালদীঘি ময়দানে গিয়ে গায়েবানা জানাজার উদ্দেশ্য জড়ো হই। উপস্থিত জনতার উদ্দেশে দুয়েকজন শিক্ষার্থী কথা বলেন। তারপর জানাজার নামাজ শেষ করে আমি মাইক হাতে নিয়ে সমবেত জনতাকে নিউ মার্কেট হয়ে কাজীর দেউড়ির দিকে মিছিল নিয়ে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান করি। মিছিল অগ্রসর হয়ে কাজীর দেউড়ী গেলে শত শত পুলিশের মহড়া দেখতে পাই। এক পর্যায়ে পেছন থেকে সাঁজোয়া যান এসে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়তে থাকে। ওই দিনই আমার পিঠে রাবার বুলেট লাগে। আমরা সবাই এক পর্যায়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি। মিছিল থেকে অনেককেই আটক করে পুলিশ। 

রপর থেকে সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। ফলে আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। এই সময়গুলোতে আমরা মেসের সব বন্ধুরা ভীতিকর সময় পার করছিলাম। চারদিকে পুলিশ রেড দিয়ে শিক্ষার্থী পেলেই আটক করছে- এ রকম অবস্থা। আমরা প্রায় প্রতি রাতে ১০টার দিকে খাবার খেয়ে বাসার ছাদে উঠে যেতাম। সকাল ৪-৫টার দিকে বাসায় নেমে আবার ঘুমাতাম। খুবই হতাশাগ্রস্ত সময় যাচ্ছিল। কোথাও মানুষ রাস্তায় নামতে পারছে না। আন্দোলন আর হচ্ছে কি না তা নিয়ে শঙ্কিত থাকি। এরই মাঝে যাত্রাবাড়ী ও ঢাকার নানা জায়গায় সাধারণ মানুষ আন্দোলনের সমর্থনে মাঠে নেমে এসেছে বলে জানতে পারলাম। সপ্তাহখানেক পর ডিবি অফিসে ছয় সমন্বয়ককে ধরে নিয়ে জোরপূর্বক বিবৃতি দিলে আমরা চট্টগ্রাম থেকে ঢাকার সকল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে পোস্টের মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করি। 

৩০ জুলাইয়ে ফেসবুক প্রফাইল লাল করা কর্মসূচি দেওয়ার পর দিন থেকে চট্টগ্রামসহ সারা বাংলাদেশে পুরোদমে আন্দোলন শুরু হয়। এরই মধ্যে আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ যুক্ত হয়েছে। ৩১ জুলাই চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ে মার্চ ফর জাস্টিস কর্মসূচি পালনে আমাদের নারীদের অংশগ্রহণ ছিল অবিশ্বাস্য মাত্রায়। ওই দিন নারীরা ছেলে শিক্ষার্থীদের পুলিশের কাছ থেকে কেড়ে নেয়, যা সারা বাংলাদেশে সাড়া ফেলেছে। ৩ আগস্ট নিউ মার্কেট ব্যাপক জমায়েত হয়। পরের দিনের প্রগ্রামে আওয়ামী ছাত্রলীগ যৌথভাবে হামলা করে অনেক শিক্ষার্থীকে আহত করে। শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে সরে গিয়ে ওয়াসায় জড়ো হয়ে অবস্থান নেয়। পরে মিছিল নিয়ে ওয়াসা থেকে বহদ্দারহাট গিয়ে ওই দিনের কর্মসূচি শেষ হয়। ৫ আগস্ট ঢাকা চলো কর্মসূচি ছিল। অনেক চেষ্টা করেও একটা ট্রাক বা কোনো গাড়ি ম্যানেজ করতে না পারায় শেষ দিন ঢাকায় গিয়ে পৌঁছাতে পারিনি। ওটা আমার কাছে বড় ধরনের একটা আফসোসই। হাসিনার পালানোর খবর শোনার সঙ্গে সঙ্গেই চট্টগ্রাম শহরে বিজয় মিছিল করি। বহদ্দারহাট থেকে শুরু করে নিউ মার্কেট সব জায়গায় লাখ লাখ লোকের উপস্থিতিতে বিজয় উদযাপিত হয়েছে।

জুলাই অভ্যুত্থান এই দেশের মানুষের সামনে অবারিত সম্ভাবনা এনে দিয়েছে। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের সংস্কারের মাধ্যমে সামাজিক রূপান্তর-পরবর্তী মানুষের সম্ভাবনার বিকাশ উপযোগী একটা রাষ্ট্র গঠনের আকাক্সক্ষা ব্যক্তিগতভাবে আমি লালন করি।

ইমন সৈয়দ, সদস্য, জাতীয় নাগরিক কমিটি

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫