
আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। ছবি: চাঁদপুর প্রতিনিধি
‘ঢাকাসহ সারা দেশে ছাত্রদের ওপর তখন পুলিশ গুলি করছে, নিরস্ত্র দুর্বল ছাত্রীদের পেটাচ্ছে হ্যালমেট বাহিনী। টেলিভিশন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আর পত্রিকার পাতায় এমন দৃশ্য দেখে আমাদের ভেতরে রক্তক্ষরণ হয়। এরই মধ্যে সহপাঠীদের মাধ্যমে জানতে পারি, চাঁদপুরে এর বিরুদ্ধে সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করবে, যা পরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। পরিবারকে মিথ্যে বলে ১৬ জুলাই একটি বিক্ষোভ মিছিলে আমি অংশ নেই। দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এটি আমার দায় হয়ে গিয়েছিল।’ এভাবেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নেওয়ার স্মৃতিকথা জানান চাঁদপুর সরকারি কলেজের মেধাবী শিক্ষার্থী মো. আরিয়ান।
পুরানবাজার ডিগ্রি কলেজের শিক্ষার্থী নজরুল ইসলাম বলেন, চাঁদপুরে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু থেকেই ছিল অহিংস ও শান্তিপূর্ণ। কিন্তু তৎকালীন সরকারি দলের ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা আমাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে বাধা দেন। যার ফলে ঢাকাসহ অন্যান্য জেলার সঙ্গে চাঁদপুরেও আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। আলামিন একাডেমির ছাত্রী শাখার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী মারজানা বলে, “আমাদের যৌক্তিক আন্দোলনে সরকারি দলের নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে, অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। ২ আগস্ট চাঁদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বানে ‘রিমেম্বার দ্য হিরোস’ কর্মসূচি ছিল। বিকেল ৩টা থেকে শত শত শিক্ষার্থী শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ডের ফয়সাল শপিং কমপ্লেক্সের সামনে জড়ো হয়। আমরা সেখানে অবস্থান নিয়ে আমাদের দাবির পক্ষে স্লোগান দিতে থাকি। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে হঠাৎ করেই ছাত্রলীগ-যুবলীগের একটি গ্রুপ আমাদের ওপর হামলা চালায়। তারা আমাদের ১০ থেকে ১৫ জন ছাত্রছাত্রীকে পিটিয়ে আহত করে। তারা মেয়েদের গায়েও হাত তুলেছে।”
সারা দেশের মতো চাঁদপুরেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুধু শিক্ষার্থীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ছাত্র আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন শিক্ষক, আইনজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক কর্মী, দিনমজুর, শ্রমিকসহ সর্বস্তরের মানুষ। এর ব্যাপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল অভিভাবক, গৃহিণীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের মধ্যে। চাঁদপুরের রাজপথে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে তাদের অভিভাবকদেরও দেখা গেছে। তাদেরই একজন চল্লিশোর্ধ্ব গৃহিণী সালমা খাতুন। তিনি বলেন, ‘সন্তানের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই আন্দোলনে গিয়েছিলাম। এক পর্যায়ে নিজের সন্তানসহ অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্লোগানে গলা মিলিয়েছি আমিও। তবে মা হিসেবে আমি মেয়ের নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আবার মনে হলো, এ আন্দোলনে যে শিক্ষার্থীদের মৃত্যু হয়েছে, তারা তো আমারই মেয়ের বয়সী, আমার সন্তানের মতো। তাই নৈতিকভাবে আমিও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সংহতি প্রকাশ করেছিলাম।’
সরকারি ওয়েবসাইটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতদের যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে, তাতে চাঁদপুর জেলার ২৭ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত। তবে বেসরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা ৩১। যার মধ্যে বেশির ভাগই ছিল কর্মজীবী, খেটে খাওয়া মানুষ। আছেন শিক্ষার্থী ও আইনজীবীও। তারা চাঁদপুরসহ ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে নিহত হন।
তাদেরই একজন চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে উপজেলার শহীদ আব্দুল হান্নান। বিয়ের মাত্র আট মাসের মাথায় স্বামীকে হারিয়েছেন মুক্তা। তিনি বলেন, ‘আমার স্বামী উত্তর বাড্ডায় একটি বেকারির লাইনম্যান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৮ জুলাই রাজধানীর মধ্য বাড্ডা এলাকায় তিনি গুলিতে নিহত হন।’ অন্তঃসত্ত্বা মুক্তি বেগম আরো বলেন, ‘আমার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখার আগেই বাবাকে হারাল।’
ঢাকা মিরপুর ১০ নম্বরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন চাঁদপুর সদর উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের কোরআনের হাফেজ সাজ্জাদ হোসেন সাব্বির। তার বৃদ্ধ দাদা মো. দুদু রাজা এখনো আদরের নাতির কথা মনে করে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তার একটাই দাবি, হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।
চাঁদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখ যোদ্ধা মো. জোবায়ের ইসলাম বলেন, ‘একটি ন্যায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা রাজপথে নেমেছিলাম। তবে আমাদের যুদ্ধ কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি। যতদিন বাংলাদেশে প্রতিটা নাগরিক তার জীবন এবং জীবিকার নিরাপত্তা না পাবে, ততদিন ছাত্ররা অতন্দ্র প্রহরীর মতো রাজপথে থাকবে।’