
মহাসড়ক অবরোধ করে রাবি শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। ফাইল ছবি
কখনোই সরকারি চাকরিতে যাওয়ার তেমন ইচ্ছা ছিল না। একজন আইনের ছাত্র হিসেবে আমার ইচ্ছা ছিল আইনজীবী পেশার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার। গত ১৫ বছরের আওয়ামী সরকারের ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থার মধ্য দিয়েই তো আমার বেড়ে ওঠা। এই যে বাকস্বাধীনতাহীনতা, বৈষম্য, অলআউট ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা তার বিরুদ্ধে ভাবনার জায়গা সব সময় ছিল। সেখান থেকেই এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া।
বাংলাদেশে ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলনের মালিকানার একটা ব্যাপার থাকে। আমরা যারা রাজশাহীতে আন্দোলন করেছি আমাদের আন্দোলন যে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল না, বিষয়টি কিন্তু এমন না। আমাদের আন্দোলন কিন্তু খুবই গোছাল একটা আন্দোলন ছিল। আমরা মেয়েদের নিয়ে একটি ‘প্রীতিলতা ব্রিগেড’ গঠন করেছি। আমাদের একটি আলাদা টেকনিক্যাল টিম ছিল। আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন যে, আমাদের প্রতিটি ব্যানারের রং ছিল লাল। এ রকম আন্দোলনের প্রতিটি জিনিসে আমাদের আলাদা একটি ছাপ ছিল। সারা দেশব্যাপী আমাদের চার-পাঁচটি লিগ্যাল টিম ছিল। এমনকি সুপ্রিম কোর্টেও আমাদের একটি লিগ্যাল টিম ছিল। রাজশাহীতে প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন আইনজীবী আমাদের সাহায্য করার জন্য লিগ্যাল টিমে যুক্ত হন। এর সবই কিন্তু ছিল আমাদের রাজশাহীর আন্দোলনের অংশ।
আমরা আরেকটি জিনিস করার চেষ্টা করেছি। আন্দোলনটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু হলেও আমরা একে শহরের সঙ্গে মানুষের সঙ্গে কানেক্ট করে ফেললাম। আমরা যখন দেখলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ফাঁকা হয়ে গেছে, তখন রাজশাহীর মানুষকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন কর্মসূচি দিতে থাকলাম। এতে রাজশাহীর স্কুল-কলেজের ছোট ছোট বাচ্চারা, রুয়েটের শিক্ষার্থীরা দারুণভাবে আমাদের ডাকে সাড়া দিতে শুরু করল। আমাদের প্রতিটি কর্মসূচি সফল করার পেছনে সব থেকে বড় অবদান ছিল রাজশাহীর স্থানীয়দের। আমার জন্য একটি বিরাট ব্যাপার হয়ে থাকবে আন্দোলনের সর্বজনীনতা। কে ডান, কে বাম, কে শিবির- সবাই এক।
যখন ক্যাম্পাস বন্ধ হয়ে গেল তখন আমাদের মিছিলগুলো শুরু হতো বিনোদপুরের মণ্ডলের মোড় থেকে। সেখানে আমি সবাইকে দেখেছি। অবাক করা বিষয় হলো সেখানে কিছু মেয়ে আসত। তারা যে কোথা থেকে আসত সেটি আমি নিজেও জানতাম না। তাদের প্রত্যেকের হাতে লাঠি থাকত এবং তাদের মধ্যে সামনে গিয়ে জীবন দিয়ে দেবে এমন একটি মনোভাব ছিল। এই দিনগুলো হয়তো আমি কখনোই আর দেখতে পারব না, আর আমি দেখতে চাইও না। আমি চাই না বাংলাদেশে আবারও কোনো এক ফ্যাসিবাদ তৈরি হোক।
একটা স্মৃতি আমার সারা জীবন মনে থাকবে। সেটি হচ্ছে আমার আইন বিভাগের কিছু জুনিয়র, সিনিয়র ও বন্ধুদের প্রতি। যখন হলগুলো বন্ধ হয়ে গেল, তখন তারা প্রায় ৭০ থেকে ৮০ জন কোনোভাবেই রাজশাহী ছাড়ল না। যখন যেখানে ডাকা হতো এরা সঙ্গে সঙ্গেই হাজির হতো। সবার মাঝে একটি বিপ্লবী মনোভাব। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তার পরও তারা বলছে, বাড়িতে যাব না, আমরা আন্দোলনে থাকব। পরে তাদের জোর করে বাড়িতে পাঠানো হয়েছে। তাদের প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। ৫ আগস্ট আমার জীবনে একটি অন্যতম স্মৃতি হয়ে থাকবে। এটি আসে আমার জীবনে একটি বিশাল দায়িত্ববোধ নিয়ে।
লেখক: মাসুদ রানা, সমন্বয়ক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়