
টাংগুয়ার হাওর। ছবি: সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি
বিশাল হাওরের বুকে ছোট ছোট গ্রামগুলোকে দূর থেকে দেখলে দ্বীপের মতো মনে হয়। এক খণ্ড উঁচু ভূমি, এর মধ্যে বসতবাড়ি আর চারপাশে পানি থইথই করছে। শুষ্ক মৌসুমে বোরো জমিতে সবুজের সমারোহ। কিন্তু নেই চলাচলের জন্য সড়ক পথ, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন পাশের গ্রামের সঙ্গেও। জেলা বা উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, সেই সঙ্গে উন্নয়ন বঞ্চিত। সরকার তাদের জন্য কী পরিমাণ বরাদ্দ দিয়েছে তাও তারা জানে না অনেকেই। হাওর নিয়ে কাজ করা সংগঠনের ভূমিকাও নামেমাত্র, ফলে হাওরবাসীর কথা বলার কেউ নেই।
পারিবারিক অসচ্ছলতা ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতায় হাওর পারের শিশুরাও শিক্ষার দিক দিয়ে পিছিয়ে আছে। কাজের সন্ধানে অনেকে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে গেলেও বেশির ভাগই উন্নয়ন বঞ্চিত হয়ে বংশপরম্পরায় হাওর পারে পড়ে আছেন বাপ-দাদার ভিটায়। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ওই সব গ্রামের বাসিন্দারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বাসস্থান মৌলিক তিনটি অধিকার থেকে যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত।
শুধু টাংগুয়া নয়- মাটিয়ান, শনিসহ বিভিন্ন হাওরবেষ্টিত গ্রামগুলোতে একই চিত্র দেখা গেছে। এসব গ্রামের বাসিন্দারা শুষ্ক মৌসুমে মাটির সড়ক দিয়ে হেঁটে কোনো রকমে চলাচল করতে পারলেও বর্ষায় নৌকা ছাড়া বের হওয়ার কোনো উপায় নেই।
উপজেলা উত্তর শ্রীপুর ইউনিয়নের টাংগুয়ার হাওরের পাশেই গোলাবাড়ি গ্রামটিতে বাসিন্দারা চারদিকে টিনের বেড়া আর নিচে মাটি দিয়ে ঘর, অনেকে ইটের দেওয়াল তৈরি করে বসবাস করছেন।
এই গ্রামের এমাল মিয়া (৩২) পেশায় জেলে। তার চার ছেলে আর বউসহ পরিবারের সদস্য ছয়জন। শুষ্ক মৌসুমে বোরো ধান চাষাবাদ করেন অন্যের জমিতে, নিজের জমি নেই। দিনমজুরি করেই জীবন-জীবিকা পরিচালনা করেন। এই আয়েই তার সংসার চলে। তিনি বলেন, ‘হাওরে সরকারি বা বেসরকারিভাবে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলে হাওর এলাকার বিশাল এই জনগোষ্ঠী বেকার থাকত না। কর্মসংস্থান না থাকায় বছরের ৯ মাসই বেকার থাকতে হয় হাওর পারের মানুষের। কর্মহীন হয়ে আমরা চরম দুর্ভোগের শিকার হচ্ছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘হাওরে কয়েক বছর ধরে আগের মতো মাছও পাওয়া যায় না। মাছ পেলে বাজারে বিক্রি করে চাল-ডাল কিনে নেই। না পেলে কষ্টের শেষ নেই। আমাদের হাওর পারের মানুষের পাশে কেউ নেই।’
হাওর নিয়ে কাজ করা কিছু সংগঠনের নেতারা বাসিন্দাদের নিয়ে কোনো কাজই করছেন না বলে অভিযোগ করে তারা বলেন, ‘শুধু বছরে দু-এক বার হাওরে আসেন, তাও আবার বোরো আবাদের সময়। তখন বাঁধ নিয়ে, ব্যানার নিয়ে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে বাঁধ দ্রুত নির্মাণ করার জন্য। আর দেখা যায় বন্যা বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময়। এরপর আর তাদের খবর থাকে না। মাঝেমধ্যে কিছু সভা-সেমিনারে কথা বললেও সারা বছরই নিষ্ক্রিয় থাকে। আমরা যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত রয়ে গেলাম।’
হাওরবেষ্টিত দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আহমদ মোরাদ জানান, অবহেলিত হাওর পারের বিশাল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান নেই এবং সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় যুগ যুগ ধরে হাওর পারের মানুষ অবহেলিত রয়েছে। তাদের জন্য আলাদাভাবে সরকারি বরাদ্দ ও সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
সমাজ কর্মী আবুল হোসেন বলেন, হাওরাঞ্চলের গ্রামের বাসিন্দাদের জন্য শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার উন্নতির জন্য দায়িত্বশীলরা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করলে তাদের জীবন-জীবিকার উন্নয়ন হবে। না হলে তারা পিছিয়ে থাকবে।