Logo
×

Follow Us

জেলার খবর

মানব পাচারকারীর ফাঁদে

Icon

মেহেদী হাসান সোহাগ

প্রকাশ: ২২ মার্চ ২০২৫, ১২:১৭

মানব পাচারকারীর ফাঁদে

মানব পাচারকারী মাফিয়াচক্রের নির্যাতনে পঙ্গু আসিফ। ছবি: সাম্প্রতিক দেশকাল

মানব পাচারকারী মাফিয়াচক্রের নির্মম নির্যাতনের কথা কারোই অজানা নয়। তাদের সাজানো ফাঁদে পা দিয়ে প্রতি বছর জীবন হারাচ্ছেন শত শত যুবক। এখনো অনেকেই রয়েছেন নিখোঁজ। কেউ কেউ মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে প্রাণে রক্ষা পেলেও দেশে ফিরেছেন পঙ্গু ও নিঃস্ব হয়ে। এমনই এক মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী হয়ে সম্প্রতি পঙ্গু হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার শরিফাবাদ গ্রামের মো. আসিফ আহমেদ (২২) নামের এক যুবক। তার বাবা মো. ইউসুফ মাতুব্বরও প্রায় তিন বছর আগে লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইতালি যাওয়ার সময় নিখোঁজ হন। এবার ছেলে মানব পাচারকারীর খপ্পরে পড়ে পঙ্গু হয়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন। 

এক মাসের অধিক সময় যাবৎ দালাল মঞ্জেলকে দেওয়া ২৬ লাখ টাকা ফেরত পাওয়ার আসায় ঘুরছেন অসহায় আসিফ। কিন্তু টাকা ফেরত দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে দালাল। তার ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটিও রয়েছে বন্ধ। 

ভুক্তভোগী মো. আসিফ তার নির্মম অভিজ্ঞতার কথা জানাতে গিয়ে বলেন, ‘দালাল মেহেদী হাসান মঞ্জেলের সঙ্গে ১৪ লাখ টাকা কন্ট্রাক্ট হয়েছিল। সে বলছিল, এক সপ্তাহের মধ্যে তোমরা ইতালি থাকবা। এ রকম বইলা প্রথমে ঢাকা থেকে বিমান ফ্লাইটে দুবাই নেছে। সেখান থেকে কুয়েত-মিশর দিয়ে লিবিয়ার বেনগাজিতে পাঠায়। ওখানে রিসিভ করার পর থেকেই শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। তিন দিন বেনগাজিতে একটি ঘরে আমাদের রাখা হয়, যাকে বলা হয় রিসিভ ক্যাম্প। ওই ক্যাম্পের মালিক আকাশ নামে এক দালাল। সেই রিসিভ ক্যাম্পে আটকে রেখে আট লাখ টাকা নেয় দালাল মঞ্জেল। ঠিকমতো খাবার দিত না। কোনো কথা বললেই মারধর করত। সেই ক্যাম্পে আরো প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ জন বাংলাদেশি লোক বন্দি ছিল। তাদের শরীর পচে যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিল। তিন দিন পর সেখান থেকে আবার আমাদের একটা গাড়িতে করে বেনগাজীর গুয়াসায় শিপন নামে আরেক দালালের ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেই ক্যাম্পটা ছিল বড় একটা গোডাউনের মতো। ভেতরে বন্দি ছিল প্রায় এক হাজার ২০০ মানুষ। ওই জায়গায় নেওয়ার পর ফোন ও পাসপোর্ট সব কেড়ে নিয়ে যায় এবং বাড়িতে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। তখন আমার পরিবারের কাছ থেকে দালাল মঞ্জেল আরো ছয় লাখ টাকা নেয়। এভাবে সাত দিনে ১৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার পরে গেম দেওয়ার কথা বলে একটা হায়েস গাড়িতে তুলে আমাদের ১০ জনকে বেনগাজির অন্য এক স্থানে পাঠায়। পরে অন্ধকার একটা ঘরের মধ্যে ঢোকালে সেখানে বন্দি থাকা লোকদের কাছ থেকে জানতে পারি ওইটা মাফিয়া ঘর। মিলন নামে এক মাফিয়া আমাদের কিনে নিয়েছে। কিছুক্ষণ পরই আমাকে একা অন্য একটি রুমে নিয়ে আরো ২০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে তারা। এ সময় তাদের ফোন দিয়ে দালালকে কল করে বিষয়টি জানালে সে বলে তারা যা চায় দিয়ে দেও নাহলে তোমার ক্ষতি হবে। তখন আমি বললাম এত টাকা পাব কই। এ কথা শুনেই মাফিয়ারা আমাকে মারধর শুরু করে। আমার দুই পাঁয়ে প্রতিদিন হাতুড়ি দিয়ে পেটাত আর বাড়িতে ভিডিও কল দিয়ে দেখাত এবং বলত যে টাকা না দিলে এখান থেকে বেঁচে ফিরতে পারবি না।’

তিনি আরো বলেন, ‘টানা দুই মাস আমাকে হাতুড়িপেটা করে মাফিয়া গ্রুপের সদস্যরা, খেতেও দিত না। ১৫ দিন পর এক মিনিট বাড়িতে কথা বলতে দিত শুধু টাকা চাওয়ার জন্য। এদিকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে স্ত্রী-সন্তানসহ বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যায় দালাল মঞ্জেল। একপর্যায়ে সুদে ১০ লাখ টাকা জোগাড় করে মাফিয়াদের কাছে আকুতি মিনতি করলে আমার পরিবারের সম্পর্কে তথ্য নিয়ে ছেড়ে দেয়। পরবর্তী সময়ে লিবিয়ার মিশ্রতা নিয়ে সাগর পারের একটা ঘরে তিন মাস আটকে রাখে দালাল মঞ্জেলের লোকজন এবং আবারও গেম দেবে বলে দুই লাখ টাকা চায়। এ সময় বললাম যে মোট ২৪ লাখ তো দিলাম আবার টাকা চান কেন। তখন সে আমাকে হুমকি দিয়ে বলে, যদি ইতালি যেতে চাস তাহলে আরো দুই লাখ টাকা দেওয়া লাগবে। পরে আবার আমার বাড়ি থেকে টাকা জোগাড় করে আমার বোনের মাধ্যমে দালালের আত্মীয়দের কাছে দেয়। কিন্তু তার পরও গেম দেয়নি। বরং ওই দেশের সেনাবাহিনী দিয়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে মিশ্রতা থেকে বেনগাজিতে ফেরত আনে। সেটা ছিল চিশতী নামের এক দালালের ঘর। বিভিন্নভাবে মোট ১১ মাস আমাকে লিবিয়ায় নির্যাতন করেছে। হাঁটার শক্তি ছিল না। আমার শরীরে উকুন হয়ে গেছিল। পরে একজনের হাতে-পায়ে ধরে সেখান থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে মুমূর্ষু অবস্থায় গত ২৪ জানুয়ারি ২০২৫ বাড়ি ফিরে আসি। হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে আমার পায়ে অবিরাম মারতে থাকে মাফিয়া দালালরা। এখনও লাঠি ভর দিয়ে হাঁটতে হয়।’

আসিফ বলেন, ‘লিবিয়া থাকতেই দালাল মঞ্জেলের স্ত্রী তাসলিমা আমাকে বিভিন্ন হুমকি দিছে। সে বলে অলিদ (লিবিয়ার শীর্ষ মাফিয়া) হলো আমার ভাই। তুই যদি বাড়িতে তেমন কিছু বলস তাহলে অলিদকে বলে তোকে এমন জায়গায় পাঠাব আর জীবনে বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারবি না। অলিদ হলো লিবিয়ার বড় মাফিয়া দালাল। তার দ্বারা লিবিয়ায় সব কিছুই সম্ভব। কারণ পুলিশ প্রশাসন সব কিছুই তার হাতে। সে চাইলে একটা লোক মারতেও পারে আবার ইতালিও পাঠাতে পারে। দেশে আসার পরও মামলা করার সাহস পাইনি। তারা হুমকি দিচ্ছে মামলা করলে আমাকে মেরে ফেলবে। আমার বাবা নিখোঁজ রয়েছে। চার ভাই-বোনের মধ্যে আমিই বড় সন্তান। জায়গা জমিসহ যা হারাবার সব তো হারিয়েই ফেলছি। এখন পাওনাদাররা টাকার জন্য আমাকে প্রতিদিন চাপ দিচ্ছে। আমি টাকাগুলো ফেরত চাই। যাতে দেনা পরিশোধের পর কিছু করে খেতে পারি। তাই আগে আপনাদের (সাংবাদিক) জানালাম যেন আমার কোনো ক্ষতি করলেও প্রমাণ থাকে। পরে আইনের আশ্রয় নিব।’

সাগরপথে ইতালি যাওয়ার ইচ্ছা জাগল কেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে আসিফ বলেন, ‘গত তিন বছর আগে আমার বাবা লিবিয়া থেকে সাগরপথে ইতালি যাওয়ার সময় নিখোঁজ হয়। এখনো তার সন্ধান পাইনি। এ জন্য আমার আক্ষেপ ছিল যে আমি ইতালি যাব। তা যেভাবেই হোক।’

স্থানীয় মো. রাকিব মোল্লাসহ একাধিক ব্যক্তি বলেন, ‘মঞ্জেল অনেক দিন যাবৎ বিদেশে লোক নেওয়ার দালালি কাজে জড়িত। প্রায় ১৫ জনের মতো লিবিয়া ফেরত ভুক্তভোগী আছে। তারা দেশে ফিরে আসার পর চার-পাঁচজন মিলে এই দালালের বাড়িতে এসে সংবাদ সম্মেলন করছিল। পরে তাদের মীমাংসা করে দেওয়ার আশ্বাস দেন দালালের বোন স্বপ্না। এ সময় এলাকার গণ্যমান্য দু-তিনজন ব্যক্তি এর ভার নিয়েছিল। কিন্তু এখনো মীমাংসা হয় নাই। আমরা চাই এর একটা সুষ্ঠু বিচার হোক।’

দালাল মেহেদী হাসান মঞ্জেল তার স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে গেলেও বাড়ি দেখাশোনার জন্য তার মাছের ঘের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদকে রেখে গেছেন। তার কাছে দালাল মেহেদী হাসান ওরফে মঞ্জেলের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সে কোথায় আছে তা আমি জানি না। মাঝেমধ্যে রাতের বেলায় নম্বর খুলে ফোন দিয়ে হিসাব নেয় আবার বন্ধ করে রাখে। আমার প্রয়োজন হলেও তাকে ফোনে পাই না।’

তিনি আরো বলেন, ‘হঠাৎ করে একদিন বিশেষ কাজে বাড়ির বাইরে যাচ্ছি বলে আমার উপর বাড়ির দায়দায়িত্ব দিয়ে চলে যায়। এরপর থেকেই দেখি বাড়িতে বিভিন্ন লোকজন আসে তাকে খুঁজতে। একপর্যায়ে জানতে পারি বিদেশ নেওয়ার বিষয় তার কাছে টাকা পাবে মানুষ। এগুলো দেখে আমি এখান থেকে চলে যেতে চাইলে সে বলছে দ্রুতই সবার সঙ্গে মীমাংসা করে ফেলবে।’

এ বিষয়ে দালাল মঞ্জেলের বোন স্বপ্না বেগমের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি সাংবাদিকদের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়ি থেকে সটকে পড়েন। এমনকি তার মোবাইল নম্বরটিও কারো কাছে পাওয়া যায়নি বিধায় তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

এ বিষয়ে রাজৈর উপজেলার হোসেনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান (হাবি) বলেন, ‘আমার জানা মতে মঞ্জেল পলাতক আছে। তার খোঁজখবর নিয়ে দেখি যোগাযোগ করা যায় কি না। তবে সম্পূর্ণ বিষয়টি আমার জানা নেই।’

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫