Logo
×

Follow Us

জেলার খবর

নাটোরের শংকর ভাগে চড়ক মেলা

Icon

আরিফুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫৮

নাটোরের শংকর ভাগে চড়ক মেলা

চড়ক মেলা। ছবি: নাটোর প্রতিনিধি

মঙ্গল ও রোগব্যাধী থেকে মুক্তি পাওয়ার মানতে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব হচ্ছে চড়কপূজা। জনশ্রুতি রয়েছে, ১৪৮৫ খ্রিস্টাব্দে সুন্দরানন্দ ঠাকুর নামের এক রাজা এই পূজা প্রথম শুরু করেন। আমাদের দেশে বিভিন্ন স্থানে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে নাটোর শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে শংকরভাগ গ্রামে প্রায় দুইশ বছর ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে চড়কপূজা। গ্রামটি আজও তাদের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। গত ১৪ এপ্রিল এ এলাকায় দিনব্যাপী চড়ক মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তরা এই মেলায় এসে মনের বাসনা পূর্ণ করতে পূজা-অর্চনা ও বিভিন্ন রকম ফল, হাঁস-মুরগি ও ছাগল মানত করে।

প্রতি বছরের মতো এবারও চড়কপূজা এবং চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে দিনব্যাপী এ মেলায় হাজার হাজার মানুষের মিলনমেলা বসেছিল। তাদের কে হিন্দু, কে মুসলমান চেনা দায়। শংকরভাগের ১৪২ ঘর আদিবাসী ছাড়াও আশপাশের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সবাই মিলেই চৈত্র মাসের শেষ দিনে এক হয়ে মিশে যায় উৎসব উদযাপনে।

গ্রামের বাসিন্দা শহিদুল্লাহ শহিদ জানান, এ গ্রামে আদিবাসীদের বসবাস বেশি হলেও অনেকে গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে গেছে। এর পরও নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে বাঙালির কৃষ্টি ও ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্রতি বছরই এ সময়ে খুব ঘটা করে চড়কপূজা উপলক্ষে মেলার আয়োজন করে থাকেন তারা।

এদিকে এ মেলাকে কেন্দ্র করে বসে চিনি-গুঁড়ের জিলাপি, মুড়ি-মুড়কি, কদমা, চিনির তৈরি হাতি-ঘোড়া, মিষ্টি, হাওয়াই মিঠাই, মহিষের দুধের ঘোল, পিঁয়াজুর দোকান ইত্যাদি। মেয়েদের জন্য কাঁচের চুড়ি, মালা, ফিতা, টিপ, সিঁদুরের দোকান, দা-বঁটি, ঘটিবাটি-খুন্তি, কাঠের তৈরি নানা জিনিস ছাড়াও রয়েছে ভিউকার্ড, ঝিনুকের তৈরি শো-পিস, পলা আরো কত কিছুর পসরা।

মেলায় কৃষ্ণা রাণী দাস এসেছিলেন তার পাঁচ বছরের শিশুর রোগ মুক্তির জন্য। তিনি দুটি মুরগি ও বাতাসা মানত করেছিলেন। পাবনা জেলার রাখী সরকারের বিয়ের আট বছর পার হলেও কোনো সন্তান হয়নি। লোকমুখে শুনেছেন, এই চড়কে মানত করলে নাকি বাচ্চা হয়। তাই তিনি বাচ্চার আসায় মানত করতে এখানে এসেছেন।

মেলা প্রসঙ্গে গ্রামের ৮৩ বছরের সমেন্দ্র নারায়ণ জানান, প্রায় দুইশ বছর ধরে এখানে চড়কপূজা হচ্ছে। আগে আরো বড় করে আয়োজন করা হতো। তখন যারা চড়কগাছে ঘুরত, তাদের আগের দিন রাতে মন্ত্র দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো। তারা আগুন, ধারালো অস্ত্রশস্ত্রের ওপর খালি পায়ে দাঁড়াত। কাটত না, পুড়তও না। কিন্তু এখন আর এত নিয়ম পালন করা হয় না।

হরিপদ সাহা জানান, পুকুরে ডুবিয়ে রাখা চড়কগাছ চৈত্রসংক্রান্তির সকালে তুলে আনা হয়। পরিষ্কার করে পূজা শেষে চড়কের জন্য প্রস্তুত করা হয়। তিনটি বাঁশ একসঙ্গে বেঁধে লাল কাপড়ে জড়িয়ে নেওয়া হয়। ৪০ থেকে ৫০ ফুট উঁচু গাছের মাথায় যে চড়ক লাগানো হয়, পূজা শেষে দুধ ও জল দিয়ে স্নান করানো হয়।

পরে সন্ন্যাসীদের পিঠে বাণ (এক ধরনের বড় বড়শি) ফোঁড়ানো হয়। তারা সারা দিন জল না খেয়ে উপবাস করেন। এরপর দুপুরের পর থেকে শুরু হয় মূল আয়োজন। একে একে সন্ন্যাসীদের নেওয়া হয় শিববাড়ি মন্দিরে, সেখানে মন্ত্র এবং ঔষধি গাছের সাহায্যে সন্ন্যাসীদের আচ্ছন্ন করা হয়। কোমরে বেঁধে দেওয়া হয় লালসালু, যার ভেতরে থাকে মন্ত্রপুত কড়ি এবং ঔষধি গাছ। ফলে কোনো রকম সমস্যায় পড়তে হয় না তাদের। 

পরে দড়ি বেঁধে চড়কগাছের সঙ্গে ঘোরানো হয় সন্ন্যাসীদের। এ সময় মঙ্গল কামনায় সন্তানদের শূন্যে তুলে ধরেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা ঘুরে ঘুরে সেসব শিশুর মাথা স্পর্শ করেন। অনেক সময় কোলেও তুলে নেন, ছিটিয়ে দেন খাগরাই-বাতাসা। চড়কপূজা শেষে সন্ন্যাসীরা খাবার স্পর্শ করেন।

শংকরভাগ চড়কপূজা উদযাপন কমিটির সভাপতি হারান চন্দ্র গোস্বামী জানান, অন্যান্য বছর অন্তত ৫০ থেকে ৬০ জনকে কালা বা বড়শি ফোঁড়ানো হতো। এ বছর ৩০ জনকে ফোঁড়ানো হয়েছে। মেলা পরিচালনার জন্য ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি রয়েছে। দিনব্যাপী মেলায় বড়শি ফোঁড়ানো ও পূজা-অর্চনা করা হয়। এ উপলক্ষে গান-বাজনা করে উৎসব চলে।

তিনি আরো জানান, চড়কপূজা পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ লোকোৎসব। চৈত্রের শেষ দিনে এ পূজা অনুষ্ঠিত হয়। চড়কপূজার উৎসব চলে বৈশাখের প্রথম দু-তিন দিনব্যাপী।

Logo

সম্পাদক ও প্রকাশক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ

বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয়: ফেয়ার দিয়া ১১/৮/ই, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট (লেভেল-৮), বক্স কালভার্ট রোড, পান্থপথ, ঢাকা ১২০৫