
একের পর এক মা কাছিমের মৃতদেহ ভেসে আসছে। ছবি: কক্সবাজার প্রতিনিধি
কিছুদিন ধরে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে একের পর এক মা কাছিমের মৃতদেহ ভেসে আসছে। উপকূলে মাছ ধরার অবৈধ জালে আটকা পড়ে শত শত কাছিম মারা যাচ্ছে। সাগরে বড় নৌযান বা ট্রলারে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েও অনেক কাছিম মারা যায়। জোয়ারের পানিতে এসব মৃত কাছিম ভেসে আসছে সমুদ্রসৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে। এ ছাড়া সমুদ্রপারে ডিম দিতে এসে কুকুরের আক্রমণের শিকার হয়ে কাছিমের মৃত্যুর ঘটনাও কম নয়।
বেসরকারি একটি সংগঠনের তথ্য মতে, গত ১ জানুয়ারি থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত তিন মাস ১০ দিনে কক্সবাজার সৈকতে ৫০টির বেশি পয়েন্টে ভেসে আসে প্রায় ২৯০টি মৃত মা কাছিম। এগুলো অলিভ রিডলে প্রজাতির। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ও পেটে ডিম ছিল।
গত ৮ এপ্রিল এক দিনে সমুদ্রসৈকতের তিনটি পয়েন্টে চারটি মৃত মা কাছিম ভেসে এসেছে। এর আগে ৭ এপ্রিল ভেসে আসে আরো তিনটি। মহেশখালীর সোনাদিয়া পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার সৈকতের ৯টি পয়েন্টে ১০ দিনে অন্তত ৫০টি মৃত কাছিম ভেসে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা) কক্সবাজার শাখার সাধারণ সম্পাদক এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন জানান, মা কাছিমের মৃত্যুর অন্যতম কারণ সমুদ্র উপকূলজুড়ে অন্তত ২০ হাজারের বেশি নিষিদ্ধ জাল (বেহুন্দি, ফাঁস ও কারেন্ট জাল) পুঁতে রাখা হয়েছে। এসব জালে কাছিম আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে কোস্ট গার্ড ও মৎস্য বিভাগ অভিযান চালিয়ে কিছু জাল জব্দ করলেও বেশির ভাগই অভিযানের আওতার বাইরে থেকে যায়।
কিছুদিন আগে কক্সবাজার শহরের নাজিরারটেক সৈকতে ভেসে আসে দুটি অলিভ রিডলে প্রজাতির মৃত কাছিম। কয়েকটি কুকুর কাছিম নিয়ে টানাটানি শুরু করছিল। কাছিমের কিছুটা দূরে বালুচরে জাল সংস্কার করছিলেন কয়েকজন জেলে। মৃত কাছিমের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় জেলেরা কাছিম দুটি বালুতে গর্ত খুঁড়ে পুঁতে ফেলেন।
স্থানীয় জেলেরা বলেন, প্রায় প্রতিদিন এই সৈকতে একাধিক মৃত কাছিম ভেসে আসে। সব কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ও পেটে ডিম থাকে। সৈকতের কুকুর এসব ডিম খেয়ে নেয়। জালে আটকা পড়লে ট্রলারের জেলেরা কাছিমকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলেন। তারপর মৃত কাছিম সাগরে ফেলে দেওয়া হয়। জেলেদের মধ্যে একটি কুসংস্কার চালু রয়েছে; সেটি হলো জালে কোনো কাছিম আটকা পড়লে নাকি সেই জালে আর মাছ ধরা পড়ে না। এই কারণে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়।
উপকূলের স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, গত কিছুদিন আগে শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় তিনটি মৃত কাছিম ভেসে আসে। কাছিমগুলোর ওজন ২০ থেকে ৩০ কেজি। তাদের কোনোটির পা নেই, কোনোটির শরীরের ওপরের অংশে (পিঠে) রক্তাক্ত জখমও দেখা গেছে।
বেসরকারি সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম) প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম বলেন, ‘সমুদ্রের ময়লা-আবর্জনা ও আগাছা পরিষ্কার এবং মাছের পোনা খাদক জেলিফিশ খেয়ে সমুদ্রের জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য বজায় রাখতে অনন্য ভূমিকা রাখে কাছিম। গভীর সমুদ্রের হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে মা কাছিম ডিম পাড়তে ছুটে আসে কক্সবাজার উপকূলে। এ সময় সাগরে পুঁতে রাখা নিষিদ্ধ জালে আটকা পড়ে শত শত মা কাছিম মারা যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় সমুদ্রসৈকতে ভেসে আসা মৃত কাছিমগুলো বালুচরে পুঁতে ফেলা হয়।’
বেসরকারি একটি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, মা কাছিম সৈকতের ৩৪টি পয়েন্টে ডিম পাড়ার সুযোগ পাচ্ছে। এক দশক আগে ৫২টি পয়েন্টে ডিম পাড়ত।
সাগরে ছাড়া হলো পাঁচ হাজার কাছিমছানা
নেকমের দেওয়া তথ্য মতে, গত তিন মাসে সৈকতের ১২টি পয়েন্ট থেকে ২৬ হাজার ৯০০টি ডিম সংগ্রহ করেন স্বেচ্ছাসেবীরা। এরপর ডিমগুলো নেকমের সাতটি হ্যাচারিতে সংরক্ষণ করা হয়। এ পর্যন্ত ডিম থেকে বাচ্চা ফুটেছে পাঁচ হাজার ৯৮টি। সব ধাপে সাগরে অবমুক্ত করা হয়েছে। অবশিষ্ট ডিমগুলো থেকেও কয়েক দিনের মধ্যে বাচ্চা ফুটবে।