
পুলিশের গুলিতে আহত জাপুল সরদার ভ্যান চালাচ্ছেন। ছবি: গোপালগঞ্জ প্রতিনিধি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে আহত জাপুল সরদার (৪৪) জীবিকার তাগিদে শরীরে গুলির ক্ষত নিয়েই ভ্যান চালাচ্ছেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে চরম সংকটে পড়েছেন তিনি। জাপুল গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার ওড়াকান্দি গ্রামের বাসিন্দা। ২০ বছর ধরে তিনি পাশের খাগড়াবাড়িয়া গ্রামের একটি সরকারি আশ্রয়ণকেন্দ্রে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন।
অভাবের সংসারে ছোটবেলা থেকেই জাপুলকে কখনো কৃষিকাজ, কখনো ভ্যান-রিকশা চালাতে হয়েছে। সংসারে সচ্ছলতা আনতে রিকশা চালানোর জন্য তিনি ঢাকায় যান। নারায়ণগঞ্জের মদনপুরে মেয়ের ভাড়া বাসায় থেকে রিকশা চালাতেন।
জাপুল জানান, গত বছরের ৫ আগস্ট সকালে কাঁচপুর থেকে রিকশায় তিনজন যাত্রী নিয়ে যাত্রাবাড়ী থানা মোড়ে যাচ্ছিলেন। তখন থানার সামনে পুলিশ-ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ চলছিল। জীবন বাঁচাতে রিকশা ফেলে দৌড়ে পালানোর সময় পুলিশের ছোড়া গুলি লাগে তার কোমরে। প্রায় আধঘণ্টা ঘটনাস্থলে পড়ে থাকেন তিনি। পরে স্থানীয়রা সংকটাপন্ন অবস্থায় তাকে মোটরসাইকেলে করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
জাপুলের মোবাইল ফোন থেকে তার মেয়ে সাথীর নম্বর সংগ্রহ করে কেউ একজন তাকে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর দেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সাথী বলেন, ‘বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে আমার ফোনে একটা কল আসে। তারা জানায়, বাবা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পরে সেই নম্বরে একাধিকবার কল করলেও বন্ধ পাই। যাত্রাবাড়ী থেকে কোনো সিএনজি বা রিকশা যেতে রাজি হচ্ছিল না। ১০ গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে প্রথমে থানার সামনে যাই। সেখানে গিয়ে বাবাকে খুঁজে না পেয়ে কয়েকটি হাসপাতালে খোঁজ নেই। এরপর স্থানীয় কয়েকজন জানান, মোটরসাইকেলে করে গুলিবিদ্ধ রোগীকে ঢাকা মেডিক্যালে নেওয়া হয়েছে। তখন এক হাজার ৫০০ টাকা দিয়ে সিএনজি ভাড়া করে ঢাকা মেডিক্যালে যাই। মর্গে খোঁজাখুঁজির পর এক নার্সকে জিজ্ঞেস করি, কোনো গুলিবিদ্ধ রোগী এসেছে কি না। তিনি বলেন, ‘ওখানে গিয়ে দেখুন, একজন ফ্লোরে পড়ে আছেন। সেখানে গিয়ে দেখি, বাবা মেঝেতে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। আমি নার্সদের বললাম, বাবা এভাবে পড়ে থাকলে মারা যাবেন, চিকিৎসার ব্যবস্থা করুন। তারা বলেন, রোগীর চাপ অনেক বেশি, সুযোগ পেলেই চিকিৎসা দেওয়া হবে।’
সম্প্রতি খাগড়াবাড়িয়া আশ্রয়ণকেন্দ্রের সামনে সড়কে জাপুলের সঙ্গে কথা হয়। আড়য়াকান্দি বাজার থেকে যাত্রী নিয়ে তিলছড়া বাজারে যাচ্ছিলেন তিনি। সেই দিনের কথা মনে করতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘মৃত্যুযন্ত্রণা কেমন, আমি তা দেখেছি। মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের সহযোগিতা আর নার্সদের চিকিৎসায় আজ বেঁচে আছি। আমি তাদের জন্য দোয়া করি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি কোনো রাজনীতি করি না। স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে আমার সংসার। জীবিকার তাগিদে রিকশা চালাতে গিয়েছিলাম, অথচ পুলিশ আমাকে গুলি করল! আমার কী অপরাধ ছিল? অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কোমরের গুলি বের করা হলেও এখনো স্বাভাবিক হতে পারিনি। ভারি কোনো কাজ করতে পারি না। ক্ষতস্থান চুলকায়, মাঝে মাঝে অসহনীয় ব্যথা হয়। ঘটনার সঙ্গে জড়িত পুলিশের বিচার চাই। আল্লাহ যেন তাদের বিচার করেন।’
জাপুলের বড় ছেলে সংসারের হাল ধরতে ভ্যান চালায়। মেজো ছেলে স্থানীয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। ছোট মেয়ে সুরাইয়া শিশু শ্রেণিতে পড়ে। বড় মেয়ের বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু স্বামীর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় সে ফিরে এসেছে। তারও একটি কন্যাসন্তান আছে। এত বড় সংসারের খরচ চালাতে একটি ভ্যান কিনে রাস্তায় নেমেছেন জাপুল।
জাপুলকে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা, জেলা জামায়াতের পক্ষ থেকে ৫০ হাজার এবং জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে ১৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। কাশিয়ানী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারজানা জান্নাত বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে আহত জাপুল সরদারকে সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে। উপজেলার প্রশাসন তার পরিবারের খোঁজখবর রাখছে। ভবিষ্যতে সরকারিভাবে কোনো সহায়তা এলে তিনিও পাবেন।,