
মোস্তাফিজুর রহমান ও তার কন্যা মায়িশা ফাহমিদা এশা
কভিড-১৯ নামের অদৃশ্য এক প্রাণঘাতী ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ে যাচ্ছে সারা পৃথিবী। সাধারণ রোগীদের পাশাপাশি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন মারা যাচ্ছেন চিকিৎসকরাও। করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশে স্বাস্থ্য বিভাগের নানা সংকট ও অব্যবস্থাপনার মাঝেও জীবন বাজি রেখে দৃঢ় মনোবল নিয়ে ফ্রন্টলাইনে থেকে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন অনেক চিকিৎসক।
কেউ কেউ এ যুদ্ধে নেমেছেন সপরিবারে। করোনা যুদ্ধে মানুষের সেবায় এমনই দৃষ্টান্ত গড়েছেন পাবনার চিকিৎসক মোস্তাফিজুর রহমান ও তার কন্যা মায়িশা ফাহমিদা এশা। এরই মাঝে সেবা দিতে গিয়ে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ডা. মোস্তাফিজ, ঝুঁকিতে রয়েছেন মেয়ে ডা. এশাও।
ডা. মোস্তাফিজ পাবনা সদর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকেই সদর উপজেলায় গঠিত মেডিকেল টিমের নের্তৃত্ব তার কাঁধে। করোনাকালে শুধু নির্দেশনা নয়, করোনা উপসর্গ নিয়ে সাহায্য প্রার্থী মানুষের ত্রাণকর্তায় পরিণত হয়েছিলেন তিনি। আক্রান্তদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে নমুনা সংগ্রহ, চিকিৎসার ব্যবস্থা, বাড়ি লক ডাউন থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজে নিজে উপস্থিত থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে। পরিবারের সদস্যদের মায়া ত্যাগ করে রাত-দিন কাজ করছেন দেশের তরে, মানবতার জন্য।
এরই মাঝে গত ২৫ মে ঈদের দিন ঢাকায় মারা গেছেন তার পিতা যশোর বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আফসার উদ্দিন। বাবাকে হারিয়েও দায়িত্ববোধ ও পেশাগত দায়বদ্ধতার প্রতি অবিচল থেকে কাজ করে গেছেন ডা. মোস্তাফিজ। সতকর্তা অবলম্বন করলেও কোনো এক সুযোগে করোনাভাইরাস প্রবেশ করেছে তার শরীরে।
জ্বর ও ঠাণ্ডার উপসর্গ দেখা দিলে গত সপ্তাহে আইসোলেশনে চলে যান মোস্তাফিজ। গত রবিবার রাতে তার করোনার রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে।
ডা. মোস্তাফিজের বড় মেয়ে মায়িশা ফাহমিদা এশা। পাবনার অতি পরিচিত ও জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীত শিল্পী ঢাকার হলিক্রস মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দিয়েছেন সেখানকার হাসপাতালে। করোনা চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল টিম বি ফোরের হয়ে কাজ করছেন। গত ১০ দিন টানা হাসপাতালের করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন শেষে এখন ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন।
গতকাল সোমবার (৮ জুন) তার নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। আক্রান্ত না হলে কোয়ারেন্টিনের সময় পার হলে ফিরবেন কাজে।
তবে আক্রান্ত হলেও মানসিক ও শারীরীক ভাবে ভাল আছেন ডা. মোস্তফিজ। উপসর্গ এখন অনেকটাই নেই। বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি।
মুঠোফোনে তিনি বলেন, অসুস্থতায় রোগমুক্তির জন্য মানুষ ঈশ্বরের পরেই নির্ভর করেন চিকিৎসকের উপর। অসহায় মানবতার সেই নির্ভরতায় চেষ্টা করেছি পেশাগত দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করার। আশা করছি দ্রুতই সুস্থ হয়ে আবারো কাজে ফিরতে পারবো।
চিকিৎসক মেয়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাবা হিসেবে সন্তানের জন্য তো দুঃশ্চিন্তা হয়, কিন্তু পেশাগত দায়বদ্ধতা ও মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে সে যেভাবে কাজ করছে তাতে অনেক বেশী গর্বিত হই। আল্লাহ তাকে সুস্থ রাখুন।
ডা. এশা বলেন, চাকরিতে ঢুকেই এমন এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছি, যার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তবে আমরা সবসময় মানুষকে সেবা দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আইসোলেশন সেন্টারে করোনাভাইরাস আক্রান্তদের চিকিৎসায় দায়িত্ব পালনকারীদের তালিকায় আমার নাম দেখে আমার একটুও ভয় লাগেনি। বরং এই দুরবস্থায় মানুষের জন্য কিছু করতে পেরে গর্ববোধ করছি। বাবা মানুষের সেবা করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাকে দ্রুত সুস্থতা দান করবেন। বাবার জন্য আমি সবার কাছে দোয়া চাই।
কভিড যোদ্ধা এই দুই সদস্যকে নিয়ে পরিবারের সদস্যদের মনে যতটা না ভয় কাজ করে, তারচেয়েও বেশি গর্ববোধ করেন তারা। দেশের জন্য কাজ করা করোনাযোদ্ধা স্বামী ও মেয়ের জন্য এখন গর্বিত ডা. মোস্তাফিজের স্ত্রী পাবনা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক মেহের সুলতানাও।
তিনি বলেন, মানবতার এ ক্রান্তিলগ্নে আমার স্বামী, মেয়েসহ চিকিৎসকরা করোনার বিরুদ্ধে এই যুদ্ধে জয়ী হবে বলেই বিশ্বাস করি। প্রথম প্রথম একটু ভয় লাগত; কিন্তু মোস্তাফিজ ও এশার মানুষের প্রতি ভালোবাসা আমাকে মুগ্ধ করেছে, সাহস বাড়িয়ে দিয়েছে ওদের জন্য সত্যিই গর্ববোধ করি।
পাবনা সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, করোনা প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় ডা. মোস্তাফিজ ও তার মেয়ে অনবদ্য ভূমিকা রেখে দৃষ্টান্ত গড়েছেন। ডা. মোস্তাফিজ দিন-রাত অমানুষিক পরিশ্রম করেছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে যখন যে সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে, তিনি নিজে ছুটে এসেছেন। আক্রান্ত মানুষের সেবা করতে গিয়ে তিনি ও তার দলের আরো দুই সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। ইনশাআল্লাহ তারা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠবেন।