আলেকজান্ডার সেন্টার খাল মাছ ঘাট। এ ঘাটের তিন দিকে নদী ও খালে রাতের বেলায় যেন জোনাকির ন্যায় আলো জ্বলছে। মনে হয়েছিল পুরো এলাকা একটি বিয়ে বাড়ি। ঘাটে মাছ বিক্রি করতে আসা জেলেদের নৌকার আলো দূর থেকে দেখতে বিয়ে বাড়ি কিংবা জোনাকির মতো লাগে।

শুধু রামগতি নয়, মেঘনা নদীকে ঘিরে রামগতি আলেকজান্ডার থেকে শুরু হয়ে চাঁদপুর সীমান্ত পর্যন্ত কয়েক হাজার মানুষের চলে জীবন-জীবিকা, এতে বছরে প্রায় কোটি টাকার ইলেক্ট্রিক পণ্য কিনতে হয় নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের, এমনটিই জানিয়েছেন এ পেশার সাথে জড়িতরা।

স্থানীয় জেলেরা জানিয়েছে, লক্ষ্মীপুরের প্রধান নদী মেঘনার বুকে বছরের বেশিরভাগ সময়ই সারি সারি হাজার হাজার নৌকাতে এখন এমন আলো চোখে পড়ে। শুধু আলোই না, নদীতে ভেসে বেড়ানো সব নৌকাতে রয়েছে ডিজিটাল নানা সামগ্রী। এসব পণ্য সামগ্রী ব্যবহারে জেলেদের নিরাপত্তা বৃদ্ধি হয়েছে। বেড়েছে নানা সুযোগ এবং জ্বালানি হিসেবে কেরোসিন ব্যবহার বন্ধ হওয়ার কারণে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন জেলেরা। বিগত কয়েক বছরে জেলেদের জীবনে এমন ব্যতিক্রম পরিবর্তন হয়ে গেছে বলে জানান জেলেরা। 

গত ৬-৭ বছর যাবত জেলেদের নৌকাসহ নদীতে ভাসমান নৌযান আলোকিত করতে বছরে কোটি টাকার ইলেকট্রিক পণ্য বিক্রির বাজার গড়ে ওঠেছে লক্ষ্মীপুরের পুরো মেঘনাপাড় জুড়ে। স্থানীয় জেলে, ব্যবসায়ী এবং নদী এলাকার বিভিন্ন মানুষের সাথে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। 

ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহের একদিন মেঘনা নদীর লক্ষ্মীপুর অংশে নৌকা ভ্রমণের মেঘনার বুকে চর রমনী মোহন এলাকায় মাঝ নদীতে দেখা যায়, ইলিশের জাল ফেলে কয়েকজন জেলে নৌকা নিয়ে মাছ উঠানোর জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের নৌকার কাছে যেতেই চোখে পড়লো জেলেদের কয়েকজন স্মার্টফোনে গান শুনছেন। ২/৩ জন ছবি দেখছেন। মাঝ নদীতে ফোন চার্জ দেয়া হয় কীভাবে কাছে গিয়ে এমন প্রশ্ন রাখতেই একজন নৌকার উপরে থাকা সৌর বিদ্যুতের প্যানেলের দিকে ইশারা দিয়ে দেখালেন। পরে মুখে বললেন সৌর বিদ্যুতেই তাদের সব কাজ হয়। 

নৌকার মাঝি ইব্রাহীম জানায়, মোবাইল ফোন চার্জ দেয়া, রাতে অন্য নৌযান থেকে নিজেদের জাল রক্ষার জন্য জালের মাথায় নিশানা বাতি, অন্য নৌযানের সাথে নিজেদের নৌকার সংঘর্ষ এড়াতে নৌকাতে নিশানা বাতি, ভেতরের আলো এবং সংকেত বাতি ইত্যাদি সব কাজেই এখন তারা সৌর বিদ্যুৎ ও আধুনিক ইলেকট্রিক পণ্য ব্যবহার করেন। 

নৌকায় থাকায় ইউছুফ মাঝি জানায়, ৬-৭ বছর আগেও নদীতে মাছ ধরার সময় রাতের বেলায় অন্য নৌকা ও ফিশিংবোট প্রায়ই ধাক্কা দিত। এতে নদীতে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। এখন আর তা হয় না। এখন নৌকায় নিশানা বাতি ও ভেতরে আলো থাকার কারণে দূর থেকে যে কোনো নৌযানের চোখে পড়ে। মূলত নৌকায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে এমন সুযোগ ও নিরাপত্তা তৈরি হয়েছে। 

এ প্রতিবেদকদের বহনকারী নৌকার মাঝি আলমগীর জানায়, পাঁচ বছর আগে ৫০ ওয়াটের একটি সৌর বিদ্যুতের চ্যানেল লাগিয়েছেন তিনি। এতে তিনটি বাতি ও একটি ছোট পাখা চলে। 

তিনি আরো জানান, আগে নৌকার বাতি জ্বালাতে মাসে প্রায় দেড় হাজার টাকার কেরোসিন ব্যবহার করতেন। তাছাড়া বৈরী আবহাওয়া ও ঝড়ের সময় কেরোসিন বাতি নিভে যেতো। এখন সে রকম সমস্যা নেই। অন্যদিকে মাসে দেড় হাজার টাকা খরচ বেঁচে গেছে। 

রামগতি উপজেলার টাংকি বাজার মাছ ঘাটের সভাপতি মো. আবদুর রব জানান, গত ১০-১২ বছর থেকেই নদীর জেলেরা সৌরবিদ্যুত ব্যবহার করছেন। এর ফলে তাদেরকে আগের মতো ঝামেলা পোহাতে হয় না। আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন সামগ্রী আর সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করে জেলেরা রাতে মাছ শিকার করেন, জাল মেরামত করেন, নদীতে জাল ফেলেন, জাল উঠায়, মাছ সংগ্রহ করেন, ফোন চার্জ দেয়, রান্না-বান্নাসহ সব কাজ করেন। এখন সৌর বিদ্যুৎ ছাড়া জেলেদের জীবন একদিনও চলে না বলেও জানান তিনি।

রামগতির আলেকজান্ডার ঘাটের মাছ ব্যবসায়ী হারুণ মিয়া জানান, এখন মেঘনা তীরের আকাশে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গে নৌকার আলোচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ে নদীর স্বচ্ছ জলে। জেলেরা রাতের প্রয়োজনীয় সব কাজ সারেন সৌর শক্তির আলোয়। এখন আর বাতাসে বাতি নিভে যাওয়ার ভয় নেই। 

মতিরহাট বাজারের ইলেকট্রিক ব্যবসায়ী ও লক্ষ্মীপুর জেলা টেলিকম অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা জসিম হাওলাদার জানান, ৬-৭ বছর আগে সর্বপ্রথম নৌকায় বিদ্যুতের সংযোগ দেয় বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। তাদের হাত ধরে জেলেরা নৌকায় বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহার শুরু করেন। এখন রীতিমতো বিপ্লব ঘটেছে। বর্তমানে এনজিও নেই। এখন স্থান দখল করেছে বিভিন্ন কোম্পানী। 

তিনি জানান, মেঘনা নদীর মজুচৌরীরহাট ঘাট থেকে রামগতির টাংকি বাজার পর্যন্ত ৫০ কিলোমিটার নদীপাড়ে ২৭০টি টেলিকম ও ইলেকট্রিক দোকান গড়ে ওঠেছে, যারা মূলত নৌকার জেলেদের নিকট ইলেকট্রিক পণ্য বিক্রি করে। 

জসিম আরো জানান, এসব দোকানদারের প্রতিজন জেলেদের নিকট প্রতিদিন পাঁচ থেকে ৫০ হাজার টাকার ইলেকট্রিক পণ্য বিক্রি করে থাকে। মাসে যা কোটি টাকার উপরে হয়। 

চর কালকিনি এলাকার জেলে কালাম জানান, একটি নৌকায় আলোকসজ্জার জন্য সৌর প্যানেল, ব্যাটারি, চার্জার, চার্জ কন্ট্রোলার, ফিশিং লাইট, জব লাইট, ওয়াচ লাইট এবং সাধারণ বাতিসহ ১০-১৫ রকমের বৈদ্যুতিক সরাঞ্জাম বিক্রি হয়ে থাকে। তার ভাষ্যমতে, প্রতিদিনই বিভিন্ন নৌকায় এ সব বৈদ্যুতিক সামগ্রীর দরকার হয়।

অন্যদিকে স্থানীয় বেসরকারি সংস্থা কোডেকের তথ্য মতে, লক্ষ্মীপুরের মেঘনায় ভাসমান নৌকায় বসবাস করছে প্রায় তিন হাজার বেদে জেলে পরিবার। সাধারণ জেলে ছাড়াও নদীতে বসবাসকারী ভাসমান বেদে জেলেরাও সৌর বিদ্যুৎ কাজে লাগিয়ে তাদের সংসারকে সাজিয়ে তুলছেন। ফলে তাদের জীবনযাত্রার চিত্রও বদলে গেছে। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে তাদের পরিবারেও। 

এ বিষয়ে গ্রামীণ শক্তির লক্ষ্মীপুর শাখার সাবেক কর্মকর্তা দুলাল সুত্রধর জানায়, মূলত গ্রামীণ শক্তি সোলারের মাধ্যমে নদীর জেলেরা বৈদ্যুতিক বাতি ব্যবহারের প্রথম সুযোগ পায়। একটি বিশেষ প্রকল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ শক্তি লক্ষ্মীপুরসহ উপকূলীয় জেলার বিছিন্ন চরাঞ্চল ও গ্রামীণ জনপদের অজোপাড়া গাঁ এবং জেলেদের নৌকায় বিদ্যুৎ সেবা পৌঁছে দেয়। 

লক্ষ্মীপুর জেলা সিনিয়ির মৎস্য কর্মকর্তার দপ্তর ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুর জেলায় মেঘনা নদীর সীমানা রয়েছে ৮৮ কিলোমিটার। যেখানে প্রায় এক লাখ অধিবাসী মৎস্য শিকারের সাথে জড়িত। 

মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, লক্ষ্মীপুরে নিবন্ধিত মৎস্যজীবির সংখ্যা ৫০ হাজার ২৫২ জন। লক্ষ্মীপুরের মেঘনা নদীতে প্রায় তিন হাজার অনুমোদিত ফিশিং ট্রলার ও কয়েক হাজার ছোট নৌকা রয়েছে বলে জানায় জেলা মৎস্য বিভাগ।