
শাহিনূর বেগম ও ইয়াকুব। ছবি: সংগৃহীত
সিনেমার গল্প বা কল্পকাহিনীকেও হার মানাবে মাফিয়াদের হাত থেকে ছেলেকে মুক্ত করতে এক মায়ের বিদেশযাত্রার কথা। বিস্ময়কর কথা হলো, যিনি কোনোদিন বিদেশ যাননি সেই তিনি লিবিয়ায় গিয়ে বিদেশি মাফিয়াচক্রের হাত থেকে ছেলেকে মুক্ত করে দেশে ফিরেছেন।
অভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফেরাতে বসতবাড়ির একটি অংশ বিক্রি করে একমাত্র ছেলে ইয়াকুবকে লিবিয়া পাঠান মা শাহিনূর বেগম। কিন্তু লিবিয়া থেকে অবৈধভাবে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে ইয়াকুবকে অপহরণ করেন মাফিয়ারা। ছয় মাস ধরে ছেলের খোঁজ না পেয়ে পাগলপ্রায় মা সুদূর লিবিয়া পাড়ি জমান। তিনি সেখানে গিয়ে মাফিয়াদের হাতে উদ্ধার করে বন্দি ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে এনেছেন।
মা শাহিনূরের এমন সাহসী ভূমিকা ও ছেলের প্রতি ভালোবাসার দৃষ্টান্ত দেশজুড়ে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। গত ২১ মার্চ ছেলেকে নিয়ে কুমিল্লার দেবীদ্বার উপজেলার কালিকাপুর নিজ গ্রামে ফেরেন শাহিনূর বেগম।
গতকাল মঙ্গলবার (১২ এপ্রিল) শাহিনূর বেগমের সাথে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার কালিকাপুর এলাকায় এক কক্ষের ছোট একটি টিনের ঘরে সন্তানদের নিয়ে বসবাস করেন শাহিনূর। ছেলেকে উদ্ধারের আশা দেখিয়ে দালালরা তার কাছ থেকে কয়েক লাখ টাকা নিয়েছেন। এখন প্রায় ২০ লাখ টাকা ঋণের বোঝা রয়েছে ভুক্তভোগী পরিবারের ওপর।
তিনি বলেন, ‘তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে। স্বামী লিবিয়ায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। চাচা শ্বশুরের কাছে বসতবাড়ির একটি অংশ বিক্রি করে ২০১৯ সালে ছেলেকে লিবিয়া পাঠান। সেখানে গিয়ে তেলের কোম্পানিতে কাজ শুরু করেন ইয়াকুব। তার স্বামী ও ছেলে লিবিয়ায় কাজ করে দেশে যে টাকা পাঠাতেন তা দিয়ে তার সংসার ভালোই চলে যাচ্ছিল।’
তিনি আরো বলেন, ‘২০২১ সালের শুরুতে ইয়াকুব তাকে বলেন, ‘মা আমি অবৈধ পথে সাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যেতে চাই। সেখানে গেলে বেশি টাকা উপার্জন করা সম্ভব। তিনি ছেলের কথায় রাজি হন। পরে জাহাঙ্গীর নামে এক দালালকে চার লাখ টাকা দিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে যাওয়ার পথে নৌকা লিবিয়ার কোস্টগার্ডের কাছে ধরা পড়ে ইয়াকুব।’
‘সেখানে নির্যাতন সহ্য করে ২২ দিন জেলে থাকার পর কোস্টগার্ডকে চার লাখ টাকা দিয়ে ইয়াকুবকে ছাড়িয়ে আনেন তার বাবা আবুল খায়ের। এ ঘটনার আট মাস পর ইয়াকুব আবারো অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার কথা ভাবেন। তখনই ঘটে যায় লোমহর্ষক ঘটনা। দ্বিতীয় দফায় ইতালি যাওয়ার পথে মাফিয়াদের হাতে ধরা পড়েন ইয়াকুব। তখন তার ছেলের সাথে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়।’
ইয়াকুব বলেন, ‘মাফিয়ারা আমাকে আটক পর পর ব্যবহারের মোবাইল ও সাথে থাকা সব টাকা নিয়ে নেন। তারা আমাকেসহ প্রায় ৩০০ জনকে মাটির নিচে একটি ছোট অন্ধকার আটকে রাখেন। সেখানে খাবার ঠিক মতো দেওয়া হতো না। অসুস্থ হয়ে কেউ মারা গেলেও তারা কর্ণপাত করতেন না।’
তিনি আরো বলেন, ‘মাফিয়াদের হাতে আগের আটক হওয়া সাতজন বাঙালি আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তারা আমাদের অনেক মারধর করতেন। কারণ, মাফিয়ারা তাদেরকে বলেছিলেন, আমাদের ঠিক মতো শাসন করতে পারলে তাদের ছেড়ে দেওয়া হবে। তাই তারা কথায় কথায় আমাদেরকে মারধর করতেন। মাফিয়ারা বাঙালি দালালের মাধ্যমে জিম্মি করার বিষয়টি প্রত্যেক বন্দির পরিবারকে জানিয়ে মুক্তিপণ চাইতেন। ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে পরিবারের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়েও বন্দিদের তারা আটকে রাখেন ‘
শাহিনূর বেগম জানান, প্রায় ছয় মাস আমার ছেলের সন্ধান না পেয়ে তিনি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন। লিবিয়াতে তার স্বামী আবুল খায়ের ছেলের শোকে স্ট্রোক করে অসুস্থ হয়ে পড়েন। দালালদের টাকা দিয়েও ছেলের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই তিনি নিজে লিবিয়া গিয়ে ছেলেকে খুঁজে বের করার সিদ্ধান্ত নেন।
তিনি আরো জানান, তিনি নিজে কুমিল্লা গিয়ে পাসপোর্টের জন্য আবেদনপত্র জমা দেন। তারপর স্বামীর সহযোগিতায় ভিসা ও বিমানের টিকিট সংগ্রহ করেন। এ বছরের ৮ জানুয়ারি লিবিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন তিনি। ছেলের চিন্তায় বিমানেও অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি।
শাহিনূর বেগম বলেন, প্রথমে দুবাই যান তিনি। পরে দুবাই থেকে বাঙালির সহযাত্রীদের সহযোগিতায় লিবিয়ার বেনঘাজিতে স্বামীর কাছে পৌঁছান তিনি। সে সময় ছেলেকে খুঁজে পাব কিনা শুধু তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। তখন তার স্বামী খুব অসুস্থ ছিলেন। লিবিয়ায় তিনি একাই ছেলের খোঁজ করেন।
ইয়াকুব বলেন, ‘কয়েকমাস চেষ্টা করার পর আমাদের দেখাশোনা করতেন এমন একজনের কাছ থেকে একটি মোবাইল চেয়ে নিতে সক্ষম হই। তখন বাবাকে কল দিয়ে বলি, মাফিয়ারা আমাকে আটকে রেখেছেন। আমি যে জায়গায় অবস্থান করছিলাম সে জায়গার নাম জানাই। কোনো দালালকে টাকা না দিয়ে অন্য কোনো পদ্ধতিতে আমাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার অনুরোধ করি। মাত্র ১৭ সেকেন্ড কথা বলতে পেরেছিলাম বাবার সাথে।’
ছেলের কল পাওয়ার পর আমি আরো পাগলের মতো হয়ে যাই বলে জানান শাহিনূর।
তিনি বলেন, ‘তখন আমি প্রতিজ্ঞা করি, যেকোনো উপায়ে মাফিয়াদের হাত থেকে আমার ছেলেকে উদ্ধার করতেই হবে। তখন লিবিয়ায় প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন বাঙালিকে আমার ছেলের বিষয়টি খুলে বলি। তাদের সহযোগিতায় আমি বাংলাদেশ দূতাবাস এবং জাতিসংঘের অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) সাথে যোগাযোগ করি। দূতাবাস ও আইওএমের কর্মকর্তারা সব শুনে আমাকে সাহায্য করেন। তখন সেখানে তাদের প্রতিনিধি দল পাঠিয়ে আমার ছেলের ছবি এনে দেন। আমি ছবি দেখে চিনতে পারিনি। ছেলের অবস্থা এত খারাপ ছিল, ছবিতে ছেলেকে দেখে চারদিন অসুস্থ ছিলাম।’
‘আইওএমের কর্মকর্তারা লিবিয়া সরকারের সহযোগিতায় ইয়াকুবকে উদ্ধার করেন। সেই সাথে সেখানে বন্দি থাকা আরো ২৫০ বাংলাদেশিকে উদ্ধার করা হয়। আমার ছেলে উদ্ধার হলেও তার সাথে প্রথমে দেখা করতে পারিনি। তারা আমাকে ফোনে কথা বলিয়ে দেন। ছেলের কান্নার শব্দ শুনে আমিও কেঁদে ফেলি। তাকে একনজর দেখার জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। ছেলে যখন ত্রিপলিতে অবস্থান করছিল তখন আমি বেনগাজিতে ছিলাম।’
শাহিনূর জানান, বাংলাদেশ দূতাবাসের সহযোগিতায় গত ১০ মার্চ তার ছেলেকে দেশে পাঠানো হয়। তিনিও তাদের সহযোগিতায় ১৬ মার্চ বাংলাদেশে ফেরেন। দেশে ফেরার পর তার ছেলের দেখা হয়। ঢাকায় সরকারের সহযোগিতায় একটি ক্যাম্পে এক সপ্তাহ থাকার পর কুমিল্লায় নিজ গ্রামে এসে ইয়াকুবের চিকিৎসা করানো হয়। এখনও সে মানসিকভাবে অসুস্থ রয়েছে বলে জানান তিনি।
মায়ের সাহসী ভূমিকা নিয়ে ইয়াকুব বলেন, আমার মা পৃথিবীর সেরা মা। আমি ভেবেছি বন্দি অবস্থাতেই আমি মরে যাব। আমার মা আমাকে উদ্ধার করার জন্য টাকা ধার করে লিবিয়া যাবে স্বপ্নেও ভাবিনি। আবারো প্রমাণ হলো, মায়ের ভালোবাসার কোনো তুলনা করা যায় না।
প্রতিবেশী ওমর ফারুক বলেন, লিবিয়া গিয়ে ছেলেকে উদ্ধার করে মা ঘরে ফিরেছেন- বিষয়টি বিস্ময়কর মনে হচ্ছে। তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন এই ছেলের জন্য। মায়ের এমন ভালোবাসা বাংলাদেশে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
শাহিনূর বেগম বলেন, ‘কোনো মায়ের সন্তান যেন অবৈধভাবে ইতালি না যায়। সরকারের কাছে আমার অনুরোধ- আমার ছেলের জন্য যেন একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। আমি আর তাকে বিদেশ পাঠাব না। বাংলাদেশি কিছু দালাল আমার ছেলেকে খুঁজে দেওয়ার কথা বলে লাখ লাখ টাকা নিয়েছে। সরকারের সহযোগিতা পেলে আমি তাদের নামে মামলা করব। আমার কষ্টের টাকা ফেরত চাই। আমাদের বর্তমানে ২০ লাখ টাকা ঋণ আছে। আমার বসতঘর ছাড়া আর কিছু নেই।’