
বরিশার-৪ আসনের সংসদ সদস্য পংকজ নাথ
বরিশার-৪ (হিজলা-মেহেন্দীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য পংকজ নাথ ও মেহেন্দীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. তৌহিদুজ্জামানের মধ্যে কথোপকথনের একটি অডিও কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। ১ মিনিট ৯ সেকেন্ডের এই কল রেকর্ড নিয়ে গত দুদিন ধরেই রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে।
তবে কে বা কারা এটি ফাঁস করেছেন সেটি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। যদিও ভাইরাল হওয়া কল রেকর্ডটি নিজের নয় বলে দাবি করেছেন বরিশাল-৪ আসনের সংসদ সদস্য পংকজ নাথ। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছেন বলে অভিযোগ করেন পংকজ নাথ।
জানা গেছে, হিজলা ও মেহেন্দীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে গঠিত বরিশাল- ৪ আসনে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সংসদ সদস্য পংকজ দেবনাথ ও তার বিরোধী একটি পক্ষের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে বিরোধ চলছে। এর মধ্যে এক পক্ষের নেতৃত্বে পংকজ নাথ থাকলেও অপর পক্ষের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুস ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং পৌর মেয়র কামাল উদ্দিন খান।
রাজনৈতিক বিরোধ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই দুই পক্ষের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। গত কয়েক বছরে দুই পক্ষের আধিপত্য নিয়ে বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী নিহত এবং গুরুতর আহতও হয়েছেন।
সবশেষ গত চার জুলাই রাতে মেহেন্দিগঞ্জ পৌর শহরের চরহোগলায় রাতুল চৌধুরী নামের এক যুবককে কুপিয়ে জখম করা হয়। রাতুলকে কুপিয়ে তার দুই হাতের রগ কেটে দেয়া হয়। রাতুল স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা বলে দাবি সংসদ সদস্যের বিরোধী পক্ষের। তবে সংসদ সদস্য পংকজ নাথ ও তার পক্ষের নেতাদের দাবি রাতুল একজন সন্ত্রাসী এবং মাদকসেবী। ওই ঘটনা নিয়ে এমপি পংকজ নাথ এবং থানার পরিদর্শকের ফোন রেকর্ড ভাইরাল হয়েছে।
কল রেকর্ডে দুজনের কথোপকথন তুলে ধরা হলো-
মুঠোফোনে কল আসার পর পরিদর্শক তৌহিদুজ্জামানকে বলতে শোনা যায়- “স্যার আদাব, স্যার”
অপর প্রান্ত সংসদ সদস্য বলেন, “আদাব, আপনি ভালো আছেন! আপনি কোথায়?”
তৌহিদুজ্জামান, “স্যার আমি পৌরসভার সামনে আছি।”
সংসদ সদস্য, “ওইখানে মারামারি যা হইছে তো হইছে, ওই শালায় তো খারাপ। ওরা মারামারি করলে আমাদের লোকজনকে বলে দিয়েছি রামদা লইয়া ওপেন সুড করতে। অরা ফাইজলামি করলে কিন্তু কামাল খান কোপ খাইবে, কেমন। যারে সামনে পাইবে হ্যারে কোপাইবো। আপনি কইয়া দেন যে সিদ্ধান্ত হইছে, মেয়র সামনে পড়লে মেয়রকেও কোপাইবো। যে সামনে পড়বে হ্যারেই কোপাইবো, কেমন!”
তৌহিদুজ্জামান, “আচ্ছা স্যার দেখছি, আমরা আছি বাইরে।”
সংসদ সদস্য, “ওসি কই, ওসি কই?”
তৌহিদুজ্জামান, “ওসি স্যারে বরিশালে আছেন, স্যার।”
সংসদ সদস্য, “ঠিক আছে, যে কোপ খাইছে সে তো খারাপ, নেশাখোর, এডিকটেড, তাই না! এ নিয়া যেন মাতবরি না করে, বাড়াবাড়ি না করে। আমি পোলাপান রে রেডি হইতে কইছি। যে, তোরা রেডি হ, যা থাকে কপালে, যুদ্ধ হইয়া যাক একটা।”
তৌহিদুজ্জামান, “আচ্ছা ঠিক আছে, স্যার।”
কথোপকথনের বিষয়ে সংসদ সদস্য পংকজ নাথ বলেন, ‘ফোনালাপের বিষয়টি লোকমুখে শুনেছি। তবে আমি শুনিনি। এটা আমার কিনা সেটা প্রমাণ না করে খবর প্রকাশ করা ঠিক হবে না। করলে তো আমাকে আইসিটি অ্যাক্টে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। আর হেমন্তের মতো সুর দিয়ে গান তো অনেকেই গাইতে পারে। এটা আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র।’
তিনি বলেন, ‘রাতুল চৌধুরী একজন সন্ত্রাসী, মাদকসেবী। মেহেদী নামে একজন যুবককে কোপাতে গেলে জনগণ তা প্রতিরোধ করেছে, সেই সময় সে আহত হয়েছে।’
সংসদ সদস্য পংকজ নাথ আরো বলেন, ‘আমি সাড়ে ৮ বছর ধরে এলাকার এমপি। এই সময়ে কোনো টু শব্দটি হয়নি। কিন্তু এখন আমার এলাকার আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিথ্যা মামলায় ঘরছাড়া, নির্যাতনের শিকার। এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে।’
তিনি এ ঘটনার পেছনে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস ও স্থানীয় মেয়র কামাল হোসেন খানকে দায়ী করে বলেন, ‘কোন নম্বর থেকে কল করা হয়েছে এটা যাচাই-বাছাই না করে ওই কলটি আমার এমন অভিযোগ তোলা গভীর ষড়যন্ত্র। আমাদের দলীয় নেতাকর্মীরা এখন খুন ও অন্য মিথ্যা মামলার আসামি, ঘরে থাকতে পারে না, তাদের কারণে। আমার গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে, আমার দলীয় লোকদের মারধর করা হয়েছে। মামলা করা হলেও সেই আসামিরা প্রকাশ্যে ঘুরছে।’
এ প্রসঙ্গে মেহেন্দিগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক তৌহিদুজ্জামানের বক্তব্য জানতে তার ব্যক্তিগত এবং সরকারি মুঠোফোন নম্বরে একাধিকবার কল করা হলেও নম্বরটি বন্ধ পাওয়া গেছে। এছাড়া থানার ওসিকে কল করা হলে তিনি রিসিভ না করে সংযোগ কেটে দেন।
অডিও কল রেকর্ড সম্পর্কে মেহেন্দীগঞ্জের পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কামাল উদ্দিন খান বলেন, ‘এটি এমপি পংকজ দেবনাথ ও মেহেন্দীগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) তৌহিদুজ্জামানের মধ্যে কথোপকথন। আমি পুরো বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের জানিয়েছি।’
বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘আমি পুরো কল রেকর্ডটি একাধিকবার শুনেছি। এটা এমপি পংকজ দেবনাথের কণ্ঠস্বর। এটা খুবই দুঃখজনক ঘটনা। দলের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ও নেতাকর্মীদের প্রতি ভালোবাসা থাকলে এমন কথা কেউ বলতে পারে না।’
কণ্ঠস্বর নকল করা হয়েছে এমপির এমন দাবি প্রসঙ্গে তালুকদার ইউনুস বলেন, ‘তার কণ্ঠস্বরে কেউ কথা বলতে পারে? আর গত ৪ জুলাই ওই ছেলেটাকে (রাতুল) কোপানোর ঘটনার পরই এই কথা বলেছেন তিনি। এটা অস্বীকার করে কীভাবে?’