গভীর রাতে লঞ্চে সন্তান প্রসব, আজীবন ভ্রমণ ফ্রি (ভিডিও)

বরিশাল প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৯ আগস্ট ২০২২, ১৮:১৭
-62ff7f73b78a6.jpg)
এমভি প্রিন্স আওলাদ-১০ লঞ্চের ডেকে জন্ম নেওয়া শিশু। ছবি: বরিশাল প্রতিনিধি
সন্তান প্রসবের জন্য এখনো বাকি ১৮ দিন। তাই আগেভাগেই স্বজনদের সাথে ঢাকা থেকে লঞ্চযোগে বরিশালের বাড়িতে ফিরছিলেন অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূ। কিন্তু যাত্রা পথে রাত সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ শুরু হয় প্রসব বেদনা। এরপর একজন অভিজ্ঞ ধাত্রীর সাহসিকতায় রাত ১টার দিকে লঞ্চের ডেকেই ফুটফুটে পুত্র সন্তান প্রসব করেন ঝুমুর বেগম নামের গৃহবধূ।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে মেঘনা নদীতে চলন্ত বরিশাল-ঢাকা নৌ-রুটের এমভি প্রিন্স আওলাদ-১০ লঞ্চের ডেকে এই ঘটনা ঘটে। বর্তমানে মা এবং নবজাতক উভয়েই সুস্থ আছেন। বর্তমানে তাদেরকে বরিশাল শেবাচিম হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে রাখা হয়েছে।
জামালপুরের গৃহবধূ ঝুমুর বেগমের বাবার বাড়ি বরিশাল সদর উপজেলার শোলনা এলাকায়। তার স্বামী মো. হারিছুর রহমান নারায়ণগঞ্জে পোল্ট্রি মুরগির ব্যবসা করেন। সন্তান সম্ভবা হওয়ায় মা এবং স্বজনদের সাথে ঢাকা হয়ে বরিশালে বাবার বাড়ি ফিরছিলেন ঝুমা। লঞ্চে জন্ম নেয়া নবজাতক তার দ্বিতীয় সন্তান।
এদিকে, যাত্রাপথে প্রসূতি মায়ের স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব করাতে পেরে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন প্রায় ৬০ বছর বয়সী নারী ধাত্রী রানী বেগম। তাছাড়া লঞ্চে সন্তান প্রসব করা মায়ের সুচিকিৎসার জন্য লঞ্চে কোম্পানির পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে ১০ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা। পাশাপাশি সন্তান প্রসব করায় শিশুসহ তার মা-বাবাকে প্রিন্স আওলাদ কোম্পানির যেকোনো লঞ্চে আজীবন বিনামূল্যে ভ্রমণের নিশ্চয়তা দিয়েছেন লঞ্চ মালিক।
ঘটনার সময় সাথে থাকা ঝুমুর বেগমের মা মিরু বেগম জানান, তার মেয়ে জামালপুরে শ্বশুর বাড়িতে থাকে। হিসেব অনুযায়ী আরো ১৮ দিন পরে ঝুমুরের সন্তান প্রসব করার কথা। তাই আগে ভাগেই তাকে নিয়ে বরিশালে আমাদের বাড়ির উদ্দেশে রওয়ানা হই। সাথে ঝুমুরের ৮ বছরের ছেলে সাইমুন, আমার ছেলে বেল্লাল ও পুত্রবধূ রুমকি, আরেক মেয়ে লিপি ও নাতি রিফাত ছিলো।
তিনি বলেন, জামালপুর থেকে ঢাকা সদরঘাট এসে প্রিন্স আওলাদ-১০ লঞ্চে উঠি। রাত ১১টার দিকে হঠাৎ ঝুমুরের প্রসব বেদনা শুরু হলে আমরা বিপাকে পড়ে যাই। নদী পথে কোথায় স্বাস্থ্যকেন্দ্র খুঁজে পাবো। চলন্ত লঞ্চে কোথায় পাবো চিকিৎসক নার্স বা আয়া (ধাত্রী)। এ নিয়ে আমরা পরিবারের সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ি। এমন চিন্তার মাঝেই বিষয়টি লঞ্চ স্টাফদের জানাতে বাধ্য হন স্বজনরা। খবর পেয়ে লঞ্চের স্টাফরাও চিন্তায় পড়ে যান।
লঞ্চের সুপারভাইজার হৃদয় খান বলেন, বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ করে গর্ভবতী এক নারীর স্বজনরা আমাদের কাছে এসে ওই নারীর প্রসব বেদনা শুরু হওয়ার কথা জানান। আমরা তাৎক্ষণিকভাবে একটি কেবিনের ব্যবস্থা করি। কিন্তু ওই নারীকে নিয়ে ওই মুহূর্তে কেবিনে স্বজনরা যেতে না চাইলে কোম্পানির পক্ষ থেকে ডেকেই প্রসবের সকল ব্যবস্থা করে দেই। সেই মুহূর্তে লঞ্চে থাকা একজন ধাত্রী ও অপর একজন নার্স ঘটনাস্থলে এসে হাজির হন। তাদের দুইজনের প্রচেষ্টায় রাত ১টার দিকে স্বাভাবিকভাবেই শিশু সন্তানটি জন্ম হয়। শিশুটি যখন জন্ম নেয় তখন লঞ্চ মেঘনা নদীতে চলছিল। এরপর সকালে মা ও শিশুকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে বাড়িতে নিয়ে যায়।
লঞ্চে সন্তান প্রসবে সহযোগিতায় এগিয়ে আসা ষাটোর্ধ্ব নারী ধাত্রী রানী বেগম বলেন, আমার বাসা বরিশাল নগরীর সাগরদী এলাকায়। কিছুদিন পূর্বে ঢাকায় মেয়ে জামাইয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। বেড়ানো শেষে মেয়েদের নিয়ে বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা সদরঘাট থেকে এমভি প্রিন্স আওলাদ-১০ লঞ্চে উঠে বরিশালের উদ্দেশে রওয়ানা হই।
তিনি বলেন, মাঝ রাতে হঠাৎ ঝুমুরের প্রসব বেদনা শুরু হয়। তখন তার স্বজন এবং লঞ্চের স্টাফরা প্রসব করানোর জন্য অভিজ্ঞ লোক খুঁজতে শুরু করে। এসময় আমি নিজে থেকেই ঝুমুরের কাছে যাই। দীর্ঘ ১৫ বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে বুঝতে পারি কিছু সময়ের মধ্যেই ঝুমুরের সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে যাচ্ছে। তাই লঞ্চের লোকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র নিয়ে নিরাপদ সন্তান প্রসব করানোর কাজে লেগে যাই। কিছু সময়ের চেষ্টায় নিরাপদে ঝুমুরের শিশু সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়।
ভূমিষ্ঠ হওয়া শিশু ও তার মা সুস্থ থাকায় ভালোলাগার অনুভূতি প্রকাশ করে ধাত্রী রানী বেগম বলেন, ১৫ বছরে অনেক শিশু আমার হাতে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। কিন্তু এরকম বিরল অভিজ্ঞতা আমার জীবনে প্রথম। মধ্য রাতে কূল-কিনারাহীন নদীর মাঝে চলন্ত লঞ্চে সন্তান প্রসব যেন-তেন বিষয় নয়। সাহস নিয়ে করেছি বলেই হয়তো সবকিছু ভালোভাবে হয়েছে। সকালে যখন বরিশাল ঘাটে লঞ্চটি এসে পৌঁছায়, তখন শিশুটি ও তার মাকে সুস্থ দেখে যে ভালো লেগেছে তা টাকা দিয়েও উপলব্ধি করতে পারতাম না।
ঝুমুরের ভাই বেল্লাল বলেন, বোন আর তার সদ্যজাত সন্তান নিয়ে ভালোভাবে বরিশালে আসতে পেরেছি তার জন্য ওই খালাম্মার অবদান সবচাইতে বেশি। আর লঞ্চের লোকজন তো সবকিছুতেই সাহায্য করেছে।
এমভি প্রিন্স আওলাদ-১০ লঞ্চের ব্যবস্থাপক জিল্লুর রহমান বলেন, শুক্রবার ভোর ৫টার দিকে ঝুমুর বেগম ও তার ফুটফুটে শিশুসহ লঞ্চটি নিরাপদে বরিশাল নদী বন্দরে এসে পৌঁছায়। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার বিষয়টি লঞ্চের মালিক রাতেই জানতে পারেন। তার নির্দেশে কোম্পানির পক্ষ থেকে ঝুমুর বেগম ও তার সন্তানকে নগদ ১০ হাজার টাকা উপহার প্রদান করা হয়েছে। একই সাথে শিশুটিসহ তার বাবা-মাকে আজীবন কোম্পানির যেকোনো লঞ্চে বিনামূল্যে ভ্রমণের নিশ্চয়তা দিয়েছেন লঞ্চ মালিক।
এদিকে, বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটের লঞ্চগুলোতে চিকিৎসা-সেবার ব্যবস্থা না রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অনেক যাত্রী। তারা বলেন, লঞ্চগুলোকে ঠিকই বিলাসবহুল করে তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু এভাবে মাঝনদীতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তার প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদানের কোনো ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে না। বৃহস্পতিবার রাতে লঞ্চে যদি অভিজ্ঞ ধাত্রী না পাওয়া যেতো তবে কি যে হতো তা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বিলাসবহুল লঞ্চগুলোতে অন্তত একজন করে অভিজ্ঞ স্বাস্থ্যকর্মী রাখার দাবি যাত্রীদের।