
উত্সবের আমেজ ও সুরের মূর্ছনায় লালনের তীর্থভূমি। ছবি: প্রতিনিধি
বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ১৩২তম তিরোধান দিবস উপলক্ষ্যে উত্সবের আমেজ ও সুরের মূর্ছনায় মেতে উঠেছে কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ার লালন মাজার। তিন দিনব্যাপী আয়োজিত অনুষ্ঠানে হাজার হাজার দর্শনার্থী ও বাউল-সাধু-ভক্তদের পদচারণায় লালনের তীর্থভূমি ছেঁউড়িয়া পরিণত হয়েছে বাউল ও সাধু-ভক্তের মিলনমেলায়।
গতকাল মঙ্গলবার (১৮ অক্টোবর) দ্বিতীয় দিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর। বিশেষ অতিথি ছিলেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার খাইরুল আলম, পৌর মেয়র আনোয়ার আলী, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুন্সি মনিরুজ্জমান, উপজেলা চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা, নাগরিক কমিটির সভাপতি ডাক্তার অধ্যাপক এস এম মুস্তানজিদ, ডাক্তার এ এফ এম আমিনুল হক রতন ও লালন একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক তাইজাল আলী খান।
অনুষ্ঠানে মুখ্য আলোচক ছিলেন লালন একাডেমির সাবেক সহসভাপতি আবদুর রশীদ চৌধুরী। জেলা প্রশাসক মো. সাইদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় অন্যান্যের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নাসরিন বানু, এনডিসি শাহেদ আরমান, ড. আমানুর আমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা জাহিদ হোসেন, ইউপি চেয়ারম্যান এনামুল হক মঞ্জু প্রমুখ।
বক্তারা বলেন, লালন ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ। তার আধ্যাত্মিকতা ও দর্শন নিয়ে দেশ-বিদেশে গবেষণা হচ্ছে। মানবতাবাদী গানের মধ্য দিয়ে তিনি মানুষে মানুষে ভালোবাসা ও মানবতার জয়গান গেয়েছেন। তিনি সত্য প্রতিষ্ঠা ও সত্যের অনুসন্ধান করে গেছেন। লালনের মানবতাবাদী গান ও অহিংস বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার ওপর তাগিদ দেন বক্তারা। ফকির লালন স্বশিক্ষিত ও আত্মপরিচয়ে ছিলেন নীরব। মানব কল্যাণ ও সত্যানুসন্ধানের কথাই বলে গেছেন তিনি। ফকির লালনের প্রধান কীর্তি হচ্ছে তার গানের কথা ও সুর। প্রায় দুই শতাব্দীকাল তার মানবদরদি গান মরমি মানসের তৃষ্ণা-রস মিটিয়ে আসছে। তার গানের অন্তর্ময় প্রেম ছুঁয়ে যায় মানুষের মন।
আলোচনা শেষে দ্বিতীয় পর্বে শুরু হয় জমকালো সংগীতানুষ্ঠান। নবীন-প্রবীণ বাউল শিল্পীসহ প্রখ্যাত গায়ক টুটুল বাউল ও শফি মণ্ডল মঞ্চে গান গেয়ে রাতভর মাতিয়ে রাখেন দর্শক-শ্রোতাদের। শিল্পীদের পরিবেশিত হূদয়গ্রাহী গানের তালে তালে হাজার হাজার দর্শক-শ্রোতাও উপভোগ করেন মনোমুগ্ধকর লালনসংগীত। মূল মঞ্চের অনুষ্ঠান ছাড়াও অডিটোরিয়ামের নিচতলার উন্মুক্ত স্থানসহ কালী নদীর পাড়ে বসে বাউলদের খণ্ড খণ্ড গানের আসর। মাজার দর্শন, সাধুসঙ্গ ও গানে গানে বাউলরা পার্থিব সবকিছু ভুলে লালনের আধ্যাত্মিকতাকে খুঁজে পেতে দারুণভাবে একাত্ম হয়ে যান।
এই অনুষ্ঠানে কোনো দাওয়াতপত্রের প্রয়োজন হয় না। দিন-ক্ষণ হিসাব করেই সাধু-ভক্তরা অনুষ্ঠানে আসতে প্রহর গুণতে থাকেন। লালন ভক্তরা জানান, লালন ফকির জীবদ্দশায় ভক্ত-শিষ্যসহ সাধন-ভজন ও গান করতেন, অনেকটা সেই আদলেই চলছে গানের আসর। গানের অনুষ্ঠান ছাড়াও বিশাল মাঠে বসেছে গ্রামীণ মেলা। এ মেলার তিন শতাধিক স্টলে বিভিন্ন জিনিসপত্রের পসরা সাজিয়ে বসেছে দোকানিরা।
উল্লেখ্য, ১৮৯০ সালের গত সোমবার (১৭ অক্টোবর) লালন দেহত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর তার ইচ্ছানুযায়ী আখড়া ঘরের মধ্যেই ডান পাশে লালনকে সমাহিত করা হয়। এছাড়া মাজারের মধ্যেই বামপাশে লালন ফকিরের পালক মা মতিজান ফকিরানীকে কবরস্থ করা হয়। ১৯৬৩ সালে ফকির লালন ও তার পালক মায়ের সমাধিস্থলকে ঘিরে তৈরি করা হয় নয়নাভিরাম মাজার । আজ বুধবার (১৯ অক্টোবর) অনুষ্ঠানের পরিসমাপ্তি ঘটবে।