
সাদা গোলাপি দেখতে পাহাড়, নীল জলের পুকুর ও স্রোতহীন নদীর নৈসর্গিক সৌন্দর্য অনুভব করতে দুর্গাপুর অতুলনীয়। এই নয়নাভিরাম স্থানটি বাংলাদেশের উত্তর অঞ্চলে অবস্থিত।
নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা যা ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের স্মারক ধারণ করে। দেশের অন্যান্য পর্যটন স্পটের মতো প্রচার না হলেও দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা অন্যতম সুন্দর স্থান।
দুর্গাপুর বহুমুখী টপোগ্রাফিতে সমৃদ্ধ। দুর্গাপুরের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটন স্পটগুলোর মধ্যে রয়েছে সোমেশ্বরী নদী, সাদা-মাটির পাহাড়, নীল পানির লেক, রানিখং চার্চ, হাজং মাতা রাশিমনি মনুমেন্ট, কালচারাল একাডেমি, মহারাজা সুসঙ্গের প্রাসাদ, হাজং জনগোষ্ঠীর আদিবাসী সম্প্রদায়, গারো গ্রাম, দশা ভুজা মন্দির, রামকৃষ্ণ মন্দির, বিজয়পুর বর্ডার, অরেঞ্জ ফরেস্ট, কংশ নদী, গজারি ফরেস্ট ইত্যাদি।
দুর্গাপুরের মাটিতে পা রাখলেই সোমেশ্বরী নদীর মোহনীয় সৌন্দর্য মন কেড়ে নেবে। এটি দেশের অন্যতম অত্যাশ্চর্য নদী। ভারতের মেঘালয়ে গারো-খাসিয়া রেঞ্জের অন্তর্গত গারো পাহাড় থেকে উৎপন্ন এই পাহাড়ি নদীটি বিজয়পুর সীমান্ত, নেত্রকোনা দিয়ে দেশে প্রবেশ করেছে। দুর্গাপুরের বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখতে নৌকায় করে সোমেশ্বরী নদী পার হতে হয়।
ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এই মায়াবী নদী সোমেশ্বরী এই প্রাকৃতিক দৃশ্যে পরিবর্তন আনে। বর্ষার বৃষ্টি এই নদীকে অশান্ত করে তোলে কিন্তু এর সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দেয়। মেঘালয় পাহাড়ের পটভূমিতে অবস্থিত এই নদীটির সৌন্দর্য আপনার চিরকাল মনে থাকবে। তবে শীতকালে পানি প্রায় শুকিয়ে যায়।
সাদামাটির পাহাড় এলাকা দুর্গাপুরের আরেকটি অবিস্মরণীয় প্রাকৃতিক সম্পদ। দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি ইউনিয়নের সিরামিক হিলস সারা বিশ্বের ভ্রমণপিপাসুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য খ্যাতি অর্জন করেছে। কুল্লাগড়া ইউনিয়নের লাইমস্টোন লেকের আশেপাশেও এই মাটির টিলা পাওয়া যায়। এই পাহাড়গুলোকে সাধারণ পাহাড় থেকে আলাদা করে তুলেছে তাদের আশ্চর্যজনক সাদা গোলাপি রঙের মাটি।
এই একচেটিয়া চেহারার পেছনে রহস্য হলো মাটির বিশেষ রাসায়নিক গঠন। ১৯৬০ সাল থেকে সিরামিক কোম্পানিগুলো সিরামিক পণ্য এবং ক্রোকারিজের উপাদান সংগ্রহের জন্য বিরিশিরিতে খনন করেছিল। ভ্রমণে কিছু রোমাঞ্চ যোগ করতে এই সিরামিক পাহাড়গুলোকে হাইক করতে পারেন। বর্ষাকালে এসব পাহাড়ের উপত্যকায় নীল জল জমে থাকে যা পরিবেশকে আনন্দময় করে তোলে।
বিজয়পুর অরেঞ্জ গার্ডেন এই এলাকার একটি বহুল পরিচিত পর্যটন পাহাড়ি স্পট, যেখানে ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের সুন্দর দৃশ্য এবং মৌসুমে কমলা গাছ রয়েছে। একটি ওয়াচ টাওয়ারও রয়েছে।
সাদা গোলাপি পাহাড়ের পটভূমিতে একটি সুরম্য নীল জলের পুকুরের পাশে কিছু শান্ত মুহূর্ত কাটানো যায়। কুল্লাগড়া ইউনিয়নে নীল পানির লেক নামে এমন একটি স্বর্গীয় স্থান দেখা যায়। এই নীল জলের হৃদয়-ছোঁয়া প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আত্মাকে প্রশান্ত করে তোলে যা ব্যস্ত জীবনের কোলাহল থেকে অনেক দূরে নিয়ে যাবে।
এই হ্রদটি নীল পুকুর, সাদা মাটির হ্রদ নামেও পরিচিত। নীল জলের পেছনের রহস্য হলো মাটিতে রাসায়নিক কপার সালফেটের উপস্থিতি। তবে এই পুকুরের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে জলে ঝাঁপ দেওয়া যাবে না। চুনাপাথর হ্রদটি গভীর। তাই সাঁতার কাটার সময় জীবন বিপন্ন হতে পারে।
দুর্গাপুরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত সংলগ্ন বিজিবি ক্যাম্প রয়েছে। এই জায়গা থেকে ভারতের মেঘালয়ের সবুজ পাহাড়ের মন-ফুঁকানো মেঘ-আলিঙ্গন উপভোগ করতে পারেন। সোমেশ্বরী নদীর পাশে বিজিবি ক্যাম্প থাকায় আশেপাশের জায়গা দেখার জন্য নৌকা ভ্রমণ করা যায়। দুর্গাপুরের উত্তরে বাদামবাড়ি, দাহাপাড়া, লালটিলা, ফান্দা ভ্যালি, গোপালপুরের সৌন্দর্যও মুগ্ধ করে।
দুর্গাপুর থেকে কলমাকান্দা পর্যন্ত সীমান্ত সড়ক দিয়ে বর্ডার ড্রাইভে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করা যায়। বিজয়পুর বিডিআর ক্যাম্পের দিকে যাত্রার সময় হাজং রাশিমনি স্মৃতিসৌধ দেখা যায় যা হাজং রাশিমনির সাহসী আত্মত্যাগের স্মরণে নির্মিত।
বিজয়পুর বিজিবি ক্যাম্পের কাছে কমলা বাগানের পাহাড় যা দুর্গাপুরের আরেকটি পর্যটন আকর্ষণ। রিসোর্টটির এক কিলোমিটার অদূরেই এই পাহাড়ে রয়েছে কমলা, মাল্টা ও পামঅয়েল প্রভৃতি বাগান। পাহাড়ের উপরে মনপ্রাণে প্রশান্তি এনে দেয় সোমেশ্বরী নদী ও ভারতের মেঘালয়ের অপরূপ দৃশ্য। এই পাহাড়ের পাদদেশে রয়েছে বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য।
তাছাড়া বিজিবি ক্যাম্পের আশেপাশে রানিখং চার্চে কিছু সময় কাটানো যায়। এই স্থানটি ১৯১০ থেকে ১৯১৫ সাল পর্যন্ত নির্মিত হয়েছিল। একটি টিলার উপরে দাঁড়িয়ে এই ঐতিহাসিক গির্জাটি ধার্মিক মন এবং পর্যটক উভয়কেই আকর্ষণ করে।
দুর্গাপুরে হাজং এবং গারো- দুটি জাতিগোষ্ঠীর জীবনধারা পর্যবেক্ষণ করা যায়। এই জাতিগোষ্ঠীর সংস্কৃতি এবং ইতিহাস সম্পর্কে আরও জানা যায় দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে ট্রাইবাল কালচারাল একাডেমি এবং মহারাজা (রাজা) সুসঙ্গের প্রাঙ্গণে।