ট্রাকচাপায় মিনুর মৃত্যু ও দাফন নিয়ে রহস্য

চট্টগ্রাম প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪ জুলাই ২০২১, ১৭:০০

চিরমুক্তি মিলেছে অন্যের সাজা খাটা মিনু আক্তারের
২৮ জুন বায়েজিদ লিংক রোডে দ্রুতগামী একটি ট্রাকের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন এক নারী। তাকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করায় পুলিশ। পরের দিন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেলে পুলিশই তাকে অজ্ঞাত লাশ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করে। দাফনের পাঁচ দিনের মাথায় সেই পুলিশই বলেছে- এই অজ্ঞাত নারী অন্যের সাজা খেটে জেল থেকে বের হওয়া আলোচিত মিনু আক্তার।
রবিবার (৪ জুলাই) বিষয়টি জানাজানি হলে এখানে রহস্য দেখছেন মিনুকে জেল থেকে বের করিয়ে আনা আইনজীবী গোলাম মাওলা মুরাদ।
তিনি সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘অন্যের হয়ে মিনুর সাজা খাটার বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। জেল থেকে বের হওয়ার মাত্র ১২ দিনের মাথায় মিনুকে গাড়ি চাপা দেয়া, অজ্ঞাত লাশ হিসেবে দাফন করা। এসব কিছুই রহস্যজনক মনে হচ্ছে। পাঁচদিন পর পুলিশ বলছে তারা যাকে অজ্ঞাত লাশ বলে দাফন করেছে সেটি মিনুর লাশ। তার চেহারা মিডিয়ার মাধ্যমে সবাই চেনার কথা। তাহলে যখন মারা গেছে তখন কেন পুলিশ চিনতে পারেনি?’
‘বিষয়টির তদন্ত হওয়া উচিত। মিনু যেখানে অন্যের হয়ে সাজা খেটেছেন সেখান থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। আমরা উচ্চ আদালতের নজরে আনব বিষয়টি। এর পূর্ণ তদন্ত হওয়া উচিত’, যোগ করেন অ্যাডভোকেট গোলাম মাওলা মুরাদ।
বায়েজিদ থানার ওসি মোহাম্মদ কামরুজ্জামান সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, ‘২৮ জুন ফজরের আজানের আগে লিংক রোডে থানার চেক পোস্টের পুলিশ মিনুকে দেখে। তিনি গান গেয়ে গেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছেন। মাঝে মাঝে রাস্তার মাঝখানে চলে আসছেন। এসময় আমাদের পুলিশ বেশ কয়েকবার তাকে রাস্তা থেকে সরিয়েও দিয়েছিল। এরমধ্যে যেকোনো একসময় তাকে দ্রুতগতির ট্রাক ধাক্কা দিয়ে চলে গেলে তিনি গুরুতর আহত হয়। পরে আমাদের টহল পুলিশ তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। পরের দিন তাকে বেশওয়ারিশ লাশ হিসেবে আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলামের মাধ্যমে দাফন করা হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘এরপরও আমরা মিনুর পরিচয় নিশ্চিত হতে টানা চারদিন ঘটনাস্থলের আশপাশে খোঁজ লাগাই। শনিবার ছিন্নমূলের দিকে কয়েকজনকে ছবি দেখালে তার ভাই অজ্ঞাত এ নারীকে তার বোন মিনু বলে শনাক্ত করেন। এছাড়া মিনুকে যে সময় গাড়ি ধাক্কা দেয় তখন কয়েকজন ঘটনাটি দেখেছে। এ রকম দুজনের সাথে আমরা কথা বলেছি। তারাই বলছে ঘটনাটি সড়ক দুর্ঘটনা। ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। সেই রিপোর্ট এখনো হাতে পাইনি।’
তদন্ত প্রসঙ্গে ওসি কামরুজ্জামান বলেন, ‘এ ঘটনায় অজ্ঞাত ট্রাক চালককে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এখন যদি মিনুর আইনজীবীরা তদন্তে আগ্রহী হয় তাতে আমাদের আপত্তি নেই। আমরা অলরেডি তদন্ত করছি। এখানে অন্য কোনো রহস্য নেই।’
আসামি না হয়েও তিন বছর ধরে অন্যের বদলি সাজা খেটে ১৬ জুন বিকেল ৪টার দিকে চট্টগ্রাম কারাগার থেকে মুক্তি পান নিরপরাধ মিনু। যাদের কারণে প্রায় ৩ বছর জেলে থাকতে হয়েছে, কারাগার থেকে বের হয়ে তাদের বিচারও দাবি করেছিলেন মিনু আক্তার। স্বামী তার তিন সন্তানসহ মিনুকে ফেলে চলে যায়। সন্তানদের মানুষ করতে মিনু কখনো ভিক্ষা করতেন, আবার কখনো মানুষের বাসায় কাজ করতেন। মিনু কারাগারে থাকাকালে গত মে মাসে তাঁর ছোট্ট মেয়ে জান্নাতুল মারা যায়। জান্নাতের জন্মের পরপরই মিনু কারাগারে যান। স্থানীয় শাহাদাত হোসেন নামের এক ব্যক্তি জান্নাতকে লালন-পালন করছিলেন। মিনুর আরেক সন্তান মো. গোলাপ (৭) সীতাকুণ্ডের জাফরাবাদ ইমাম হোসাইন হাকিমিয়া লোকমানিয়া সুন্নিয়া হেফজখানা ও এতিমখানায় পড়াশোনা করে। বড় সন্তান মো. ইয়াছিন (১০) একটি দোকানে কাজ করে।
মুক্তি মিলেছে অন্যের সাজা খাটা মিনুর
এখন পিতা-মাতাহারা এই দুই সন্তানকে মিনুর বড় ভাই রুবেলই দেখাশুনা করবেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত ২৮ জুন রাতে ছিন্নমূলের বাসা থেকে মিনু বের হয়ে যায়। তাকে আশপাশে খুঁজে পাইনি। পরে থানা পুলিশ শনিবার ছবি দেখালে জানতে পারি মিনু ট্রাক চাপায় মারা যায়।’
মিনুর আইনজীবীরা এ মৃত্যুতে রহস্য দেখলেও তার ভাই রুবেল বলছেন, আল্লাহ তার মৃত্যু যেভাবে রেখেছে সেভাবে হয়েছে। এখন আমরা গরীব মানুষ কি আর করব।
প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের ৯ জুলাই চট্টগ্রাম নগরের রহমতগঞ্জ এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় মোবাইল ফোন নিয়ে কথা-কাটাকাটির জেরে পোশাককর্মী কোহিনুর বেগমকে হত্যা করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর এ মামলার রায়ে আসামি কুলসুমকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। রায়ের দিন কুলসুম আদালতে অনুপস্থিত থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। প্রকৃত আসামি কুলসুম আক্তার মামলার সাজা হওয়ার আগে ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে ছিলেন। সাজা ঘোষণা হওয়ার পর ২০১৮ সালের ১২ জুন কুলসুম সেজে মিনু আক্তার কারাগারে আসেন। চলতি বছরের ২১ মার্চ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের পক্ষ থেকে আদালতে একটি আবেদন করা হয়। এই আবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালে কারাগারে পাঠানো আসামির সঙ্গে প্রকৃত আসামির মিল নেই। এছাড়া কারা রেজিস্ট্রারে থাকা দুজনের ছবির মিল নেই।
এ আবেদনের শুনানি শেষে কারাগারে থাকা মিনুকে আদালতে হাজির করে তার জবানবন্দি নেয়া হয়। তখন তিনি জানান, তার নাম মিনু, তিনি কুলসুম নন। আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রারগুলো দেখে হাজতি আসামি কুলসুম ও সাজাভোগকারী আসামির চেহারায় অমিল খুঁজে পান। তখন আদালত কারাগারের রেজিস্ট্রারসহ একটি নথি হাইকোর্ট বিভাগে আপিল নথির সঙ্গে সংযুক্তির জন্য পাঠিয়ে দেন।
পরে হাইকোর্ট গত ৭ জুন নিরপরাধ মিনুকে মুক্তির নির্দেশ দেন। এরপর ১৬ জুন মুক্তি পেয়েছিলেন মিনু। এর ১২ দিন পরই তিনি পৃথিবী থেকে চলে যান।