
ছবি: রাঙামাটি প্রতিনিধি
রাঙামাটির বরকল উপজেলার সুবলং ইউনিয়নের মিতিঙাছড়ি গ্রামের বাসিন্দা মুক্তা চাকমা। পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রতিদিন সুপেয় পানি সংগ্রহ করেন পার্শবর্তী গ্রাম চেয়ারম্যানপাড়া থেকে। মিতিঙাছড়ি থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকা যোগে আধা কিলোমিটার দূরে গিয়ে পানি সংগ্রহ করেন তিনি।
শুধু ঝর্ণা চাকমাই নন, একই গ্রামের বিদর্শন চাকমা, আঁখি চাকমা, সুপ্রিয় চাকমাসহ ৩৫-৪০টি পরিবারের সবাই একমাত্র এই নলকূপ থেকে দীর্ঘ দিন ধরে পানি সংগ্রহ করছেন। জুরাছড়ি উপজেলার দুর্গম মৈদং ইউনিয়নের ভূয়াতলীছড়া গ্রামে ১৫টি পাহাড়ি পরিবারের বসবাস। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পাথুরে হওয়ায় এই এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের কথা থাকলেও, তা আর সম্ভব হয়নি। তাই একমাত্র পানির উৎস হিসেবে কূয়ার পানি পান করে আসছেন এই গ্রামের ক্ষুদ্র জাতি সত্তার পরিবারগুলো। তবে পাহাড় থেকে নিচু এলাকায় হওয়ায় ৪শ’ ফুট উঁচু পাহাড় ডিঙিয়ে কূয়া হতে পানি সংগ্রহ করেন তারা।
পানি সংগ্রহ করার সময় ষাটোর্ধ্ব এক নারী জানান, তাদের পাড়ার মানুষ ছোট ছোট এসব কূয়া থেকে পানি সংগ্রহ করে থাকেন। আর স্নানসহ অন্যান্য কাজ সারেন ছড়ার পানিতে। এক্ষেত্রে বর্ষাকালে ছড়া ও কূয়ার পানি ঘোলাটে ও অপরিষ্কার হয়ে পড়ায়, সেই সময় দুর্ভোগ আরও চরমে ওঠে।
আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় রাঙামাটির বাঘাইছড়ির উপজেলার দুর্গম সাজেক ইউনিয়নের ৮০ শতাংশ মানুষ সুপেয় পানির সংকটে ভোগেন সারাবছর। সাজেক ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান নেলসন চাকমা নয়ন জানান, সাজেকে সারাবছরই সুপেয় পানির সংকট থাকে। তবে এ বছর অন্যান্য বছরের চেয়ে সংকট বেশি। তার ইউনিয়নের মধ্যে ব্যাটেলিং, লংকর, শিয়ালদহ, তুইথুইসহ বেশি কয়েকটি এলাকায় সুপেয় পানির জন্য বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কয়েক কিলোমিটার পাহাড়ি পথ ডিঙিয়ে এসব এলাকার মানুষকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এটি শুধু বরকলের সুবলং, জুরাছড়ির মৈদং কিংবা সাজেক ইউনিয়নের ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের হাহাকার নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলার প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামগুলোতে এই করুণ পরিস্থিতি।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা গেছে, খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার আট মাইল এলাকার মরা (মৃতপ্রায়) ছড়ায় পানি সংগ্রহে এসেছেন চন্দ্রকিরণ কার্বারি পাড়ার ডলি ত্রিপুরা এবং আট মাইল যৌথখামার এলাকার হতেন বৈষ্ণবসহ (৬০) অনেকেই। আটমাইল মরা ছড়ার একটি অংশে ওপর থেকে সামান্য পানি চুঁইয়ে পড়ছে। সেখানে এক চিলতে বাঁশ দিয়ে পানি ধরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সারিবদ্ধ হয়ে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে তাদের।
এ সময় ডলি ত্রিপুরা ও হতেন বৈষ্ণব জানান, আশপাশে এ উৎসটির বাইরে পানি সংগ্রহ করার মতো আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। তাই অতি কষ্ট হলেও, এখান থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। গোসল তো আপাতত কয়েক দিনেও করার সুযোগ হয় না। স্থানীয় রাজেশ ত্রিপুরা (৩৫) জানান, পানির এ সামান্য উৎসটি থেকে চন্দ্রকীরণ কার্বারি পাড়া, আমতলী ও আটমাইল যৌথখামার এলাকার প্রায় ৪৫০ পরিবার পানীয় জল সংগ্রহ করে থাকেন।
পাড়া ছাড়তে চান খুমীরা : বান্দরবান সদর থেকে সবচেয়ে নিকটতম উপজেলা রোয়াংছড়ির তারাছা ইউনিয়নে একটি দুর্গম পাহাড়ের অবস্থান সাংকিং খুমীপাড়া। বান্দরবানে বসবাসরত ১১টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মধ্যে সবচেয়ে কম লোকসংখ্যায় খুমীরা; কিন্তু এই খুমী জনগোষ্ঠীর জীবন সংগ্রামে এখন বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে পানি। পাড়াবাসীরা জানিয়েছেন, বহু দিন ধরে এ পাড়ার সকলকে ভোগাচ্ছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। নোংরা পানি পান করায় পানিবাহিত নানারকম রোগবালাই লেগে থাকে সারাবছর। ফলে সুপেয় পানি পাওয়া যায় এমন কোনো জায়গা পেলে যে কোনো মুহূর্তে পাড়া ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে পাড়াবাসীর।
সাংকিং খুমীপাড়ার ষাট বছর বয়সী বৃদ্ধ রেলুং খুমী জানান, আধ ঘণ্টা হেঁটে একটি মৃতপ্রায় ছড়ায় কোনো রকমে গোসল করা যায়; কিন্তু পানীয় জলের মারাত্মক সমস্যা। কাড়াকাড়ি করে একটা ছোট কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করে খেয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে। পানি সংগ্রহ ও গোসল করতে আসা যাওয়ার মধ্যে প্রতিদিন এক ঘণ্টা সময় চলে যায়। ওই পানিটাও বিশুদ্ধ নয়।
পরিবেশ কর্মী সৈকত রঞ্জন চৌধুরী জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম ক্রমান্বয়ে বৃক্ষ নিধনের পাশাপাশি ঝিরি-ঝর্র্ণার পাথর উত্তোলনও থেমে নেই। এতে করে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটছে প্রতিনিয়ত, নষ্ট হচ্ছে সুপেয় পানির উৎস। এমনভাবে চলতে থাকলে পাহাড়ে পানির সংকট আরো বেড়ে যাবে। তাই পাহাড়ে পানির উৎসগুলো টিকিয়ে রাখতে ঝিরি-ঝর্ণাগুলো সংরক্ষণে রাখতে হবে।
পরিবেশবাদী সংগঠন গ্লোবাল ভিলেজের নির্বাহী পরিচালক ফজলে এলাহী বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার ঝিরি-ঝর্র্ণাগুলো আগে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। এখন শুষ্ক মৌসুমে ঝিরি-ঝর্র্ণার পানি শুকিয়ে যায়। পাহাড়ি প্রত্যন্ত এলাকায় পানির উৎস ঝিরি-ঝর্ণা ও কূয়া; কিন্তু পাহাড়ে এখন নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, বন উজাড় ও পাথর উত্তোলনের কারণে পরিবেশের বিপর্যয় ঘটছে; পানির উৎস কমছে। কারণ গাছপালা না থাকলে তো পাহাড়ে পানি পাওয়া যাবে না। ২০২০ সালে রাঙামাটির জুরাছড়ি দুমদুম্যা ও বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নে সুপেয় পানির মাত্রাতিরিক্ত সংকট দেখা দিয়েছিল। তাই পাহাড়ের ভৌগোলিক বিষয়টি মাথায় রেখে সংশ্লিষ্টদের গবেষণার মধ্য দিয়ে এই ব্যাপারে কাজ করতে হবে। অন্যথায় পার্বত্য চট্টগ্রামের সুপেয় পানির সংকট কাটবে না; বরং আরো বাড়বে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্ততর (ডিপিএইচই) রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। ভৌগোলিক কারণে সমতলের মতো এখানে প্রকল্প গ্রহণ করে সুপেয় পানির সংকট নিরসন সম্ভব হচ্ছে না। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করে যাচ্ছি।
বিশেষত পাহাড়ি এলাকাগুলোতে ভূ-গর্ভস্থ স্তরে আমরা পানির উৎস পাই না। অনেকাংশে আবার বিভিন্ন এলাকা পাথুরে হওয়ায় গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয় না। সমতল এলাকায় ৫০ জনে একটি টিউবওয়েল স্থাপনের কথা থাকলেও, আমরা পাহাড়ি এলাকার মানুষের বসতি দূরত্বের কথা মাথায় রেখে ৩০ জনেও একটি টিউবওয়েল স্থাপন করছি।