
বিজয়নগরের মিনারা বেগম। ছবি: ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি
বৃহস্পতিবার দুপুর সোয়া দুইটা। পানির ওপর ইট দিয়ে উঁচু করে বসানো মাটির চুলায় ভাত রান্না করছেন মাঝবয়সী মিনারা বেগম। ভাত হয়ে গেলেই রান্না হবে পাঙ্গাশ মাছ ও সবজি। ধার করা শ’ তিনেক টাকা দিয়ে একটি পাঙ্গাশ মাছ আর কিছু সবজি এনেছেন বাজার থেকে। এই একটি মাত্র পাঙ্গাশ মাছ আর সবজি দিয়ে অন্তত দুইদিন আট সদস্যের পরিবার চালাতে হবে মিনারাকে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরের মনিপুর গ্রামের সিমনা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সড়কের পাশেই মাঝবয়সী মিনারা বেগমের বাড়ি। তার স্বামী জলফু মিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ। পাঁচ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে বড় ছেলে শাহ আলমের আয়েই পরিবার চলে।
অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে চার-পাঁচদিন ধরে পানিবন্দি মিনারার পরিবার। পানি ঢুকেছে ঘরে। আঙিনাতেও জমেছে হাঁটু পানি। রান্নাঘর, টিউবওয়েল ও টয়লেট- সবকিছুই তলিয়ে গেছে পানিতে। মাচার ওপর মাটির একটি চুলায় রান্না করছেন গত কয়েকদিন ধরে।
ভাত রান্নার ফাঁকেই মিনারার সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, হাতে টাকা-পয়সা নেই। বাজারে জিনিসপত্রের দামও বেশি। মাছের মধ্যে পাঙ্গাশের দামই কম। তাই দুই-তিনশ টাকা ধার করে একটি পাঙ্গাশ মাছ আর কিছু সবজি আনিয়েছি বাজার থেকে। সকালে কিছু রান্না হয়নি, আগেরদিনের পান্তা ভাত খেয়েছি। এখন মাছ ও সবজি দিয়েই দুই-তিনদিন চাল হবে। এখনো পর্যন্ত কোনো ত্রাণ নিয়ে আসেনি কেউ। ছেলেটারও রোজগার নেই। ওর দোকানে পানি উঠেছে। এখন বেচাকেনাও হচ্ছে না। কারণ এখানকার অনেক মানুষ পানিবন্দি।
মিনারার ছেলে শাহ আলম জানান, বাড়ির সাথেই তার মোবাইলসামগ্রীর দোকান। গ্রামের মধ্যে দোকান- তাই বেচাকেনা এমনিতেই কম হয়। যা আয় হয়, তা দিয়েই পরিবার চলে। কিন্তু ঢলের পানি তার দোকানের ভেতরেও ঢুকেছে। আশপাশের অনেক মানুষ পানিবন্দি। তাই দোকানে এখন বেচাকেনা নেই বললেই চলে। ফলে ধার-দেনা করে চলতে হচ্ছে।
জেলা প্রশাসনের তথ্য মতে, বিজয়নগর ছাড়াও আখাউড়া, সরাইল ও নাসিরনগর উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে প্রায় সাড়ে ৬ হাজার পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় আছে। এছাড়া বিদ্যালয়ের আঙিনায় পানি উঠার কারণে ৬২টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে নাসিরনগর উপজেলার ৪৮টি, সরাইলে ১৩টি এবং বিজয়নগরে একটি বিদ্যালয় রয়েছে। আর মৎস্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী, জেলার ১১০৪টি পুকুরের ৫ কোটি ১০ লাখ টাকারও বেশি মূল্যের মাছ ভেসে গেছে পানিতে।
সরেজমিন বিজয়নগর উপজেলার পানিবন্দি এলাকাগুলো ঘুরে দেখা গেছে, বেশ কিছু গ্রামের ভেতরের সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। বাড়ির রান্নাঘর, টিউবওয়েল ও টয়লেট এখন পানির নিচে। যেসব ঘরের ভেতরে পানি ঢুকেছে, সেসব পরিবারগুলো চরম দুর্ভোগে আছে। অনেকেই ধার-দেনা করে চলছেন। কোনো কোনো পরিবার শুধু এক বেলা ভাত খেয়ে বাকি দুই বেলা খাচ্ছেন শুকনো খাবার। ঢলের পানি কবে সরবে- সেই দুশ্চিন্তাতেই সময় কাটছে পানিবন্দি পরিবারগুলোর।
মলাই মিয়া নামে পানিবন্দি আরেক পরিবারের কর্তা জানান, তারা তিন ভাই। শুধু তার ঘরেই এখনো পানি ঢুকেনি। বাকিদের ঘরে পানি ঢুকেছে। সেজন্য সবাই এখন তার ঘরেই গাদাগাদি করে থাকছেন। কিন্তু তার ঘরেও যেকোনো মুহূর্তে পানি ঢুকে পড়তে পারে বলে জানান তিনি।
নুরুল ইসলাম নামে ক্ষতিগ্রস্ত এক মৎস্য চাষি জানান, ঢলের পানিতে তার ছয়টি পুকুর থেকে ৬-৭ লাখ টাকার বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ভেসে গেছে। কোনোভাবেই মাছগুলো রক্ষা করতে পারেননি, পানি ভেঙে সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা তাজমহল বেগম জানান, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে মৎস্য চাষিরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত জেলার ১১০৪টি পুকুরের ৫ কোটি ১০ লাখ টাকারও বেশি মূল্যের মাছ পানিতে ভেসে গেছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. রুহুল আমিন বলেন, ‘জেলার চার উপজেলার ছয় হাজারেরও বেশি পরিবার পানিবন্দি অবস্থায় আছে। ইতোমধ্যে পানিবন্দিদের কিছু পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে উঠেছে। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ সহায়তা ও নগদ অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে’।