
বন্যা পরিস্থিতি। ফাইল ছবি
কাসমির রেজা। ছেলেবেলা থেকেই হাওরের জলরাশিতে চোখ রেখে তার বেড়ে ওঠা। বেসরকারি একটি কলেজে শিক্ষকতার সুবাদে সিলেট নগরে থাকলেও মাটির টানে ঘুরে বেড়ান হাওরের বাঁকে বাঁকে। হাওরকে ভালোবেসে এলাকার যুবসমাজকে নিয়ে গড়ে তুলেছেন ‘পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থা’ নামের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন।
টেলিফোনে যখন বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, বললেন, এমন বিপর্যয় হঠাৎ করে হয়নি। প্রতিবছরই হাওর ডোবে; কৃষকের কান্না শোনে না কেউ। কয়েক বছর ধরে ডুবছে শহরও। তার মতে, এমন দুর্যোগ অনেকটা মানবসৃষ্ট। নদী গিলে খাচ্ছে দখলদাররা। বানের পানি এখন আর নামার সুযোগ নেই।
বারবার উজানের ঢলে পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে শহর থেকে গ্রাম। এই বছর তৃতীয়বারের মতো বানের পানিতে ডুবেছে সিলেট। বছর বছর এমন ঢলে হাজার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে। প্রাণ বাঁচাতে ছুটছে মানুষ। বন্যা শেষে যখন বাড়ি ফেরেন, তখন তারা নিঃস্ব। বন্যার পেছনে অতিবৃষ্টির বাইরে আরও অনেক কারণ দেখছেন গবেষকরা।
সুনামগঞ্জ সীমান্ত থেকেই ভারতের মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জি এলাকা শুরু। ফলে সেখানকার পানি সরাসরি বাংলাদেশের হাওরে মেশে। ভৈরব কিংবা মেঘনা নদী হয়ে সাগরে চলে যায়। অতীতে বৃষ্টি বেশি হলেও নদী গতিশীল ছিল। এখন নদীতে পানির প্রবাহ নেই বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক এ কে এম সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার কারণে বৃষ্টির ধরন বদলেছে। এখন অনেক ভারী বৃষ্টি হয়। চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি হলে তা ছয় থেকে আট ঘণ্টার ভেতরে তাহিরপুরে চলে আসে। সেখানে এসে পানি তো আর দ্রুত নামতে পারছে না। ফলে তখন সেটা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে বন্যা তৈরি করছে।
মানবসৃষ্ট কারণ
সিলেট শহর ও হাওরের নদীগুলোর পানি ধারণের সক্ষমতা কমে এসেছে। হাওর, খাল ও পুকুর ভরাট করে উন্নয়ন হচ্ছে। সিলেট নগরের যে উপশহর প্রতিবছরই বন্যার পানিতে তলিয়ে যায়, সেটি আগে ছিল ডিবির হাওর। সেখানে এখন আবাসন হয়েছে। ফলে যে পানি এই হাওর ধারণ করত, তা এখন সিলেট নগরে চলে আসে। একই সঙ্গে হাওরে আরও কয়েকটি বড় বড় স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। সিলেটের বেশিরভাগ পানি অপসারণের জায়গা সুরমা নদী। কিন্তু জকিগঞ্জের অমলসিদ থেকে সুনামগঞ্জের ভাটিতে মেঘনা নদী পর্যন্ত এলাকা সুরমা কখনো খনন হয়নি। এ কারণে পানি দ্রুত নামছে না। এর বাইরে কিশোরগঞ্জে হাওরের মধ্যখান দখল করে মিঠামইন-অষ্টগ্রাম রাস্তা করা হয়েছে, সেটিও সিলেটে জলমগ্ন হওয়ার কারণ বলে মনে করেন কেউ কেউ। সারি নদী বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আব্দুল হাই আল হাদী বলেন, ৩২টি আন্তঃসীমান্ত নদীর মধ্যে মাত্র আটটি নদী পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্বীকৃত। নদীকে নদী হিসেবে স্বীকৃতি না দিলে কীভাবে উদ্যোগ নেওয়া হবে? সিলেটের বিশ্বনাথের বাসিয়া নদীসহ অনেক নদীর উৎসমুখ বন্ধ ও কোনোটি আবার মরে গেছে। শুধু সুরমা ও কুশিয়ারা খনন করে বন্যা থেকে মুক্তি মিলবে না।
কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কের কারণে সিলেট অঞ্চলের বন্যা মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে-এমন বিষয় নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ ওই সড়ককে দায়ী করে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন। বাস্তবে সিলেটের পানি প্রবাহে সড়কটি কতটুকু অন্তরায় তার কোনো গবেষণা নেই।
পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, মিঠামইন সড়কটি বন্যার কারণ বলে মনে হয় না। এখনো সেই সড়কের প্রভাব তেমন পড়েনি। ভবিষ্যতে পড়তে পারে। কারণ কয়েক বছর পর ওই এলাকার হাওর ও বিল ভরাট হয়ে যেতে পারে। তখন সিলেট অঞ্চলে প্রভাব পড়বে। সিলেট শহর রক্ষার জন্য নদীর তীরে বাঁধ প্রয়োজন।