কক্সবাজার প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৩৮ পিএম
আপডেট: ২৫ আগস্ট ২০২৪, ০৭:৪০ পিএম
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যা-ধর্ষণ ও নিপীড়ণের মুখে রাখাইনের জন্মভূমি থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীরা স্বদেশে ফেরার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। রোহিঙ্গা ঢল নামার সাত বছরের মাথায় (২৫ আগষ্ট) সকাল থেকে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ক্যাম্পে লাখো শরণার্থী দ্রুত প্রত্যাবাসনের দাবিতে সমাবেশে দাবি উত্থাপন করেন। নিজ দেশে ফেরত যাওয়া আকুতি জানিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সমাবেশ করেছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা।
আজ রবিবার (২৫ আগস্ট) মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার আশায় এবং সেই ২৫ আগষ্টকে স্মরণ করতে কক্সবাজারের উখিয়া কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে এই সমাবেশে অনুষ্ঠিত হয়। এতে রোহিঙ্গা নেতারা তাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, ভিটে মাটি ফেরত ও সম্মানের সাথে মিয়ানমারে ফেরত নিয়ে যাওয়ার আকুতি জানান। রবিবার ভোর থেকে ব্যানার, ফেস্টুন নিয়ে উখিয়া ১৩ ও ১৮ নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের খেলার মাঠে জড়ো হতে থাকে রোহিঙ্গা নারী ও পুরুষ।
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ এবং ভয়াবহ নির্যাতনের মুখে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বনভূমিতে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে আশ্রয় নেওয়া সাড়ে তিন লাখসহ বর্তমানে ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজারের ৩৩টি আশ্রয় ক্যাম্পে বসবাস করছে। কবে তারা স্বদেশে ফিরবে তা এখনও অনিশ্চিত।
তবে সরকারের শরণার্থী বিষয়ক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। কিন্তু ৭ বছর হয়ে গেলেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নেই কোন অগ্রগতি। মিয়ানমার সরকার প্রত্যাবাসন নামে নাটক চালাচ্ছে। বিশ্ব নেতারাও সব অভিযোগ শুনার পর নিরবতা পালন করছে।
এদিকে, দিনের পর দিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে বাড়ছে জন্মহার। সরকারি বা এনজিওর জরিপ মতে ১২ লাখ রোহিঙ্গা ধরা হলেও সাত বছরে বেড়েছে আরও কয়েক লাখ। তাই দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন করা জরুরী বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
অনেকদিন ধরেই রোহিঙ্গাদের তাদের জন্মভূমি মিয়ানমারে পাঠানোর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হলেও নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা আর বাস্তবায়ন হয়নি। এখনও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি ঝুলে আছে। রোহিঙ্গাদের দাবি, তাদের নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই প্রত্যাবাসন সম্পন্ন করতে হবে মিয়ানমারকে।
অপরদিকে রোহিঙ্গাদের একটি অংশ মাদক পাচার, অপহরণ, মানবপাচারসহ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে শরণার্থী আশ্রয় শিবিরগুলোতে প্রতিনিয়তই খুন-সংঘর্ষের মতো ঘটনা ঘটছে। এটা স্থানীয় মানুষদের নিরাপত্তাকেও হুমকির মুখে ফেলেছে।
নিজেদের দেশে ফেরত যাওয়ার দাবি জানিয়ে রোহিঙ্গারা প্রতিবছরই এদিনে তাদের ক্যাম্পে সমাবেশের আয়োজন করে থাকে। ২০১৯ সালের ২৫ অগাস্ট ক্যাম্পে প্রথম বড় সমাবেশ করা হয়, যার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাস্টার মুহিবুল্লাহ। পরে তিনি মিয়ানমারের সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ আরসার সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হন।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সন্ত্রাস দমনের নামে ২০১৭ সালে সে দেশের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর জাতিগত নিধন চালালে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আসতে থাকে রোহিঙ্গারা। ওই বছরের ২৫ আগস্টের পর দু-তিন মাসের মধ্যেই উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয় সাড়ে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে তাদের খাদ্য সহায়তা এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হয়।
২০১৭ সালেই বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা শুরু করে। পরবর্তী সময়ে কয়েক দফা রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেওয়া হলেও একজন রোহিঙ্গাও মিয়ানমারে ফেরত যায়নি।
রোহিঙ্গারা মনে করে, তাদের নাগরিকত্ব, জাতিগত পরিচয়, জায়গা-জমি ও গণহত্যার বিচারের নিশ্চয়তা না পেলে তারা মিয়ানমারে গিয়ে আবারও সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পড়বে।
রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ উল্লাহ বলেন- আমরা কবে দেশে ফিরতে পারবো জানা নেই। ২৫ আগষ্ট আমরা সাত বছর পূর্তি উপলক্ষে ক্যাম্পের বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করছি। এই সমাবেশের মাধ্যমে আমরা বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিতে চাই, মিয়ানমারকে চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী যাতে স্বদেশে ফিরতে পারে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যেন সে উদ্যোগ নেয়।
আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) এর সভাপতি মোহাম্মদ জুবাইর বলেন- ছোট এই বাংলাদেশে রোহিঙ্গারা দিন দিন বোঝা হয়ে যাচ্ছে। তাই, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি অনুরোধ, যেকোন উপায়ে মিয়ানমারকে চাপ সৃষ্টির মাধ্যমে বিপুলসংখ্যক এই রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো হোক।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার সামসুদ্দৌজা নয়ন বলেন - ২৫ আগষ্ট রোহিঙ্গা আগমনের সাত বছর পেরিয়ে আট বছরে পদার্পণ করেছে। ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের তাদের মতো করে সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া হয়েছে । এর অংশ হিসেবে রোহিঙ্গা শিশুদের চিত্রাঙ্কন থেকে শুরু করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালা করছে।
তিনি বলেন, রাখাইনে এখন যুদ্ধ চলছে। সেখানকার পরিস্থিতি খুব খারাপ। ওখানকার যুদ্ধের গোলাবারুদের শব্দে এপারের মানুষ পর্যন্ত ভয়ে তটস্থ। কবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে সে তথ্য আমার কাছে নেই। অবশ্য, নতুন করে যাতে আর কোনও রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করতে না পারে সে ব্যাপারে সীমান্তে বিজিবি শক্ত অবস্থানে আছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh