গত ৪ বছর ধরে খোলা আকাশের নিচে অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে ১২ হাজার টন ইউরিয়া সার। সারের বস্তাগুলো উন্মুক্ত স্থানে থাকায় বৃষ্টিতে ভিজে ও রোদে পুড়ে তা জমাট বেঁধেছে। নষ্ট হয়েছে সারের গুণগত মানও।
এ সব সার সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর জেলার কৃষকদের মাঝে বোরো মৌসুমে ভর্তুকিমূল্যে বিতরণ করার কথা ছিল। কিন্তু গুণগত মান ভালো না জানিয়ে সারগুলো গ্রহণ করে অস্বীকৃতি জানায় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশনের বাফার গুদাম। ফলে সারগুলোর ঠাঁই হয় বাঘাবাড়ী নৌবন্দরে খোলা আকাশের নিচে।
২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে চট্টগ্রামের মেসার্স নবাব ট্রেডিং কোম্পানি সরকারি গুদামে সরবরাহের জন্য সারগুলো আমদানি করে। কিন্তু সারের গুণগতমান পরীক্ষার আগেই তা জমাট বাঁধায় বাফার গুদাম কর্তৃপক্ষ গ্রহণ না করে নবাব ট্রেডিংকে ফেরত দেয়। পরে ওই কোম্পানি বিষয়টির সুরাহার জন্য আদালতের শরণাপন্ন হয়। আদালত সারগুলো নিলামে বিক্রির নির্দেশ দিলেও শুরু হয়নি নিলাম প্রক্রিয়া।
সরকারের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ এবং প্রতারণার মামলায় জড়িয়ে নবাব ট্রেডিংয়ের কর্ণধার কারাগারে আছেন। অভিযোগ উঠেছে, এই সুযোগে বাঘাবাড়ী বন্দর কর্মকর্তা ও ইজারাদারের যোগসাজশে জমাট বাঁধা সার হাতুড়ি দিয়ে গুঁড়ো করে অন্য ভালো সারের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে। বিক্রি করা হচ্ছে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় কালোবাজারে। মানের দিক থেকে খারাপ এসব সার কিনে গরিব ও প্রান্তিক কৃষক পড়ছেন ক্ষতির মুখে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গুণগত মানহীন ইউরিয়া সার কৃষকদের কাছে গেলে তাতে কৃষকের সর্বনাশ হবে। বদনাম হবে সরকারিভাবে বরাদ্দ দেওয়া বিসিআইসির বাফার গুদামের সারের।
জানা যায়, ১৯৮৩ সালে শাহজাদপুর উপজেলায় বাঘাবাড়ী নদীবন্দর স্থাপন করা হয়। এটি যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। উত্তরাঞ্চলের ১৬ জেলায় এ বন্দর দিয়ে পেট্রোলিয়াম ডিপো থেকে পেট্রোলিয়াম জাতীয় দ্রব্য এবং সার সরবরাহের মধ্য দিয়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন হয়। সিরাজগঞ্জসহ উত্তরাঞ্চলের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রাখছে বন্দরটি। কিন্তু সেই অর্থনীতির চাকার গতিরোধ করতে কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী ফসল ধান উৎপাদনের একমাত্র জৈব উপাদান ইউরিয়াকে পুঁজি করে কোটি কোটি টাকা মুনাফা করলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন কৃষকরা। অসাধু ব্যক্তিরা খোলা আকাশের নিচে ফেলে রেখেছেন ১২ হাজার টন ইউরিয়া। এর মাধ্যমে দেশে ইউরিয়ার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে। সময় বুঝে সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা বেশি দামে সার বিক্রির জন্যই এমনটি করছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
স্থানীয় আব্দুল সবুর নামে এক ব্যক্তি বলেন, অনেক দিন ধরে এই সারগুলো বাঘাবাড়ী বন্দরে খোলা আকাশের নিচে ফেলে রেখেছে। যেগুলো রোদে ও বৃষ্টিতে ভিজে গুণগতমান অনেক আগেই নষ্ট হয়ে গেছে। এই সারগুলো কৃষকের কাছে সরবরাহ করলে কৃষক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আব্দুল কাদের নামে আরেকজন বলেন, বাঘাবাড়ি বন্দরে এই মানহীন সার অন্যান্য সারের সঙ্গে বস্তায় ভরে বিক্রি করছে কিছু অসাধু ব্যক্তি। যেগুলো উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হচ্ছে। কৃষক এই সার ব্যবহার করলেও তাতে কোনো লাভ হবে না।
বাঘাবাড়ী নৌবন্দরের স্টক ইয়ার্ডের প্রবেশমুখে স্থানীয় রূপবাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি আব্দুল মজিদের সাততলা ভবনের সামনেই পড়ে রয়েছে সারগুলো। আব্দুল মজিদ বন্দর ইজারাদারদের একজন। জানা গেছে, আব্দুল মজিদ নবাব ট্রেডিংয়ের কাছে টাকা পাবেন। এ টাকা আদায় করতে গোপনে বিক্রি করা হচ্ছে সার। বন্দর ইয়ার্ডের বেশিরভাগ স্থানজুড়ে সারগুলো রাখা আছে। এতে অন্যান্য সার পরিবহনের ট্রাক বন্দরে ভিড়তে বেগ পোহাতে হয়।
বন্দরের এলাকার একাধিক সূত্র জানায়, বন্দরজুড়ে ছড়িয়ে থাকা সারগুলো ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখা হলেও সময় সুযোগ বুঝে মঝেমধ্যেই রাতের আঁধারে গোপনে বিক্রি করা হয়। বন্দর ঘাটের শ্রমিক নিয়ন্ত্রণকারী ইজারাদার আব্দুস সালাম এবং ঘাট নিয়ন্ত্রক শাহ-জামাল এই সার বিক্রি চক্রের সঙ্গে জড়িত। তবে এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি। এমনকি বন্দর এলাকার অফিসেও তাদের পাওয়া যায়নি। বাঘাবাড়ি নৌ বন্দরের ইজারাদার হাজী আব্দুস সালামের ফোনে একাধিকবার ফোন করলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
প্রতিবছর সাড়ে ৪ কোটি টাকায় ঘাট দুটি তারা ইজারা নেন। অভিযোগ আছে, ইজারা নেওয়ার পর থেকেই তারা বন্দরের পুরো জায়গা যেমন খুশি তেমন ব্যবহার করতে থাকেন। তাদের সঙ্গে বন্দর কর্মকর্তার গোপন যোগসাজশের অভিযোগও আছে।
বাঘাবাড়ী বন্দরের সহকারী পরিচালক ও বাফার ইনচার্জ সিকান্দার আলী বলেন, চারপাশে অনেক স্থানে খোলা আকাশের নিচে দীর্ঘদিন থেকেই সার পড়ে আছে, সেসব আমাদের নয়। আমাদের ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার গুদামেই মজুত রয়েছে।
তিনি বলেন, কয়েক বছর আগে নবাব ট্রেডিং ৩ হাজার টন ইউরিয়া সার বাঘাবাড়ীর বাফারে নিয়ে আসে। গুণগত মান নষ্ট হওয়ায় তা বুঝে নেওয়া হয়নি।
বন্দর ইজারাদার সালামের সঙ্গে গোপনে সার বিক্রির অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি কেন সার বিক্রি করতে যাব? তাছাড়া বন্দর ইজারাদার সালামের সঙ্গেও আমার কোনো সম্পর্ক নেই।
এই কর্মকর্তা আরও জানান, বিসিআইসির সার ডিলার মোট ২৭১ জন। এর মধ্যে সিরাজগঞ্জের আছেন ১১৪ জন। ৯টি উপজেলার মধ্যে ৬টির ডিলাররা এখান থেকে সার উত্তোলন করে থাকেন। বাকি ৩টি উপজেলার ডিলাররা যমুনা সার কারখানা থেকে সরাসরি সার উত্তোলন করে কৃষকদের মাঝে বিক্রি ও সরবরাহ করেন। আর আমরা সিরাজগঞ্জ, পাবনা ও নাটোর জেলার ২৭১ জন ডিলারকে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সার এখান থেকেই দিয়ে থাকি।
শাহজাদপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জেরিন আহমেদ বলেন, সিরাজগঞ্জ ও অন্যান্য জেলায় এসব সার বিক্রি করলে কৃষক মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।তাই ওই সার যাতে কোনোভাবেই কৃষকের বাড়ি পর্যন্ত না যায় এবং ক্ষেতে প্রয়োগ না করে, সে বিষয়ে কৃষি বিভাগসহ স্থানীয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে এসব অপকর্মে বন্দর কর্তৃপক্ষের কেউ জড়িত থাকলে তাকে আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুজ্জামান বলেন, বিষয়টি জানার পর সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক বিসিআইসির চেয়ারম্যানকে ফোন করেছিলেন। বিসিআইসির একটি টিম সেখানে পরিদর্শন করছে। তারা খুব শিগগিরই ওই সারের বিষয়ে প্রতিবেদন জমা দেবে। কৃষকদের ক্ষতির কথা বিবেচনা করে বাঘাবাড়ী বন্দর থেকে জমাট বাঁধা ওই সার স্থানান্তর না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক বাবুল কুমার সূত্রধর জানান, প্রতি মাসে জেলা প্রশাসকের হলরুমে সার-বীজ মনিটরিং বিষয়ে সভা হয়। বাঘাবাড়ি ওই সারের ব্যাপারে আমাদের অবগত করেননি। তবে গুণগতমান নষ্ট হওয়া সার ব্যবহার করলে কৃষক অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই এই সার ব্যবহারে সবাইকে সর্তক থাকতে হবে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : সরকারি সার বিসিআইসি বাফার গুদাম বাঘাবাড়ী বন্দর
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh