গারো পাহাড়ে এবার কফি চাষ শুরু

শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তবর্তী গারো পাহাড়ি এলাকায় কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ফলে পাহাড়ে এই ফসলের নতুন দিগন্তে নতুন স্বপ্ন দেখছেন কৃষকরা। এখানকার কৃষিতে এ ফসল যেন এক নতুন অতিথি হিসেবে এসেছে।

উদ্যোগক্তা কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ নামের এক ব্যক্তি বিনামূল্যে কৃষকদের মাঝে কফির চারা বিতরণ করছেন। প্রতিদিন জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে কৃষকরা এসে কফি গাছের চারা নিয়ে যাচ্ছেন। এতে লাভের আশায় কৃষকরাও দারুনভাবে খুশি হচ্ছেন।

উপজেলা কৃষি অফিস, উদ্যোক্তা ও চাষিরা জানান, পৃথিবীতে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে দুই রকমের কফির চাষ রয়েছে। এই এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষের জন্য এরাবিকা ও রোবাস্টা জাতের কফি চাষ শুরু হয়েছে। রোবাস্টা জাতের কফি বাংলাদেশের আবহাওয়ায় বেশি উপযোগী। যে কারণে নালিতাবাড়ী উপজেলা পাহাড়ি অঞ্চল আবহাওয়ায় এর সম্প্রসারণ করা সম্ভব হবে। কফির চারাগুলো দেখতে কিছুটা দেবদারু চারার মতো। 

মার্চ থেকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে প্রতিটি পরিপক্ব গাছে ফুল ধরা শুরু হয়। মে থেকে জুন মাসের মধ্যে ফুল থেকে গুটি গুটি ফলে পরিণত হয়। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ফল পরিপক্বতা লাভ করে। পরে এগুলো রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। বাজারজাত ও কফি পান করার জন্য উপযোগী করতে মেশিনের মাধ্যমে কফিবীজ গুঁড়া করে নিতে হয়। 

আবার কফির বীজ থেকে চারা উৎপাদন করা যায়। ফলন ভালো হলে এবং আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে গাছ প্রতি ৫/৭ কেজি কফি পাওয়া সম্ভব। ব প্রতি কেজি কফির দাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা। প্রতি একরে ২৫০/৩০০টি গাছ লাগানো যায়। সেই হিসেবে বছরে ২০০ কফি গাছ থেকে ১ হাজার ৬০০ কেজি পর্যন্ত কফি ফলন পাওয়া যায়। যার ন্যূনতম বাজারমূল্য ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা। 

বর্তমানে এই কফি চাষে নালিতাবাড়ী উপজেলার কৃষকদের সার্বিক সহযোগিতা করছেন কৃষিবিদ সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ। তিনি একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরির সুবাদে বান্দরবন জেলায় প্রজেক্ট ইনচার্জ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বান্দরবানের রুমা উপজেলার ডার্জিলিং পাড়ায় কফি চাষ প্রথমে তার নজরে আসেন। সেখান থেকেই কফিচাষ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। 

২০২১ সালে লাল লিয়াং বং এর বাগান হতে ৫ কেজি কফি কিনে চারা উৎপাদন করেন তিনি। সেই চারা পরীক্ষামূলকভাবে পাশ্ববর্তী হালুয়াঘাট, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলায় এবং বান্দরবানের কিছু চাষিদের মাঝে বিতরণ করেন। 

এরপর আবার ২০২২ সালে আরো কিছু কফির চারা বিতরণ করেন। সেই চারাগুলো থেকে পরিপূর্ণভাবে এখন ফল দেওয়া শুরু করেছে। ওইসব কফি সংগ্রহ করে অল্প কিছু ফল নিজস্ব মেশিনে রোস্টিং করে বাজারজাত করা হচ্ছে। 

সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ জানান, গারো পাহাড়ে প্রচুর অব্যবহৃত জমিকে চাষের আওতায় আনতে আগামী দুই বছরে প্রায় দুই লাখ চারা বিনামূল্যে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। যার অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত ৬৩ চাষির মাঝে প্রায় ২০ হাজার চারা বিনামূল্যে বিতরণ করেছেন। এই চারাগুলো আগামী দুই বছরের মাথায় ফল দেওয়া শুরু করবে। এছাড়া তিনি কফি চাষিদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে চারা রোপন ও পরিচর্যা বিষয়ে অবহিত করছেন। একই সাথে সহায়ক হিসেবে একটি করে বই দিচ্ছেন। 

তিনি আরো জানান, কফি চাষে বাড়তি কোনো জমি লাগে না। বাড়ির যে কোনো বাগানে সাথী ফসল হিসেবে ছায়াযুক্ত জায়গাতে কফি চাষ করে বাড়তি আয় করছেন চাষিরা। উৎপাদিত কফি বিক্রি করার জন্য কৃষকদের কোথাও যেতে হচ্ছে না। তিনি নিজেই ন্যায্য মূল্যে কফি কিনে নিচ্ছেন। বাজারজাতকরণ ও সঠিক দাম পেয়ে চাষিরা খুশি। তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও এই কফি রপ্তানি করবেন। 

কেন বিনামূল্যে কফির চারা বিতরণ করেন এমন প্রশ্নে সাজ্জাদ হোসেন তুলিপ বলেন, নতুন ফসল হিসেবে কৃষকরা ঝুঁকি নিতে চান না। তাই নিজ উদ্যোগে চাষিদের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিনামূল্যে চারা বিতরণ করছেন। এই চারাগাছ থেকে যখন কফি উৎপাদন শুরু হবে তখন তিনি কৃষকদের কাছ থেকে ন্যায্য মূল্যে কিনে নিয়ে বাজারজাত করবেন।

উপজেলার বিন্নিবাড়ী গ্রামের চাষি বুলবুল আহাম্মেদ বলেন, আমি ২০০ চারা নিয়েছি। আমার একটি লিচু ফলের বাগান আছে সেই বাগানের ছায়ায় এই কফি গাছের চারা রোপণ করব।

রামচন্দ্রকুড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা জালাল উদ্দিন বলেন, দুই বছর আগে আমি ৫৪টা চারা লাগাই। এ বছর ৫০টা গাছে ফল ধরেছে। আমি আরও কফি চারা লাগানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।

নালিতাবাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, উপজেলার গারো পাহাড়ি এলাকার মাটিতে অম্লত্ব ও উর্বরতা শক্তি কফি চাষের জন্য বেশ উপযোগী। বৃষ্টিপাত ও মাটির গঠন বিন্যাস মিলে এই উপজেলায় কফি চাষের উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে। উদ্যোক্তার সাথেও আমাদের যোগাযোগ আছে। আমরা এ ব্যাপারে কৃষকদের সার্বিক পরামর্শ ও সহযোগিতা করে যাচ্ছি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh