ঠাকুরগাঁও প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:১১ পিএম
আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৪:২৯ পিএম
স্বপ্ন ছিল শেষ বয়সে বাবা-মায়ের ভরসা হবেন মো. লিটন। তবে ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে লিটন হয়ে গেছেন এখন পরিবারের বোঝা। গত ৪ আগস্ট ঠাকুরগাঁও শহরের কোর্টচত্বর এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন। সেই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়েছিল লিটনের পুরো শরীর।
চিকিৎসকরা বলছেন, লিটনের শরীরে এখনও প্রায় ৫০০ ছররা গুলি রয়ে গেছে। সেই গুলি বের করা সম্ভব না হওয়ায় এখনো হাঁটতে পারছেন না তিনি।
লিটনের বাড়ি ঠাকুরগাঁও পৌরশহরের দক্ষিণ সালান্দর পাড়ার মিলন নগর মহল্লায়। বাবার নাম ইয়াকুব আলী। তিন ভাইয়ের মধ্যে লিটন সবার ছোট। তিনি ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। বাবা ইয়াকুব আলী স্যানিটারি স্লাব বিক্রি করে সংসার চালান।
বর্তমানে লিটনের চিকিৎসা, সুস্থ হওয়া ও তার কাজে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। টাকার অভাবে উন্নত চিকিৎসা করাতে না পেরে বাড়িতে যন্ত্রণা নিয়ে কাতরাচ্ছেন লিটন। অভাবের সংসারে নিজের পড়াশোনার খরচ জোগাতে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন একটি ওষুধের ফার্মেসিতে। সে চাকরিও এখন হারিয়েছেন।
লিটনের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বিছনায় কাতরাচ্ছিলেন লিটন। তার পাশে হতাশা আর উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছেন তার বাবা-মা। সন্তান সুস্থ হতে পারবে কি না, এ নিয়ে চিন্তিত তারা। মা লিলি বেগমের কপালে চিন্তার ভাঁজ, আর চোখ বেয়ে ঝরছিল অশ্রু।
৪ আগস্টের রোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে লিটন বলেন, ছাত্রদের ডাকা সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিলেন। গত ৪ আগস্ট দুপুরে শহরের কোর্ট চত্বরের পূর্ব পাশের একটি গলিতে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ অবস্থান করে। এ সময় পুলিশ তাদের গুলি না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলে। চলে যাওয়ার সময় পেছন দিক থেকে লিটনের মাথায় গুলি করে পুলিশ।
জ্ঞান ফেরার পর উঠে দাঁড়ালে পুলিশ তাকে আবারও ছররা গুলি করতে থাকে। তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত সমস্ত শরীর গুলিবিদ্ধ হয়। এ সময় কোন রকম হামাগুড়ি দিয়ে পাশের একটি বাড়িতে আশ্রয় নেন। এরপর শহরের একটি ক্লিনিকে অস্ত্রোপচার করে লিটনের শরীর থেকে ১২টি গুলি বের করা হয়।
তখন পুলিশ ও ছাত্রলীগের ভয়ে ক্লিনিক ছাড়তে হয় তাকে। পরে ৬ তারিখ পরিবার সদস্যদের সহযোগিতায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয় তাকে। সেখানে তিন দিন চিকিৎসার পর রংপুর সেনাবাহিনী পরিচালিত সিএমএইচ হাসপাতালে দুই সপ্তাহ ভর্তি থাকেন। লিটনের শরীর থেকে গুলি বের করা যায়নি। চিকিৎসকের পরামর্শে এখন বাড়িতেই অবস্থান করছেন তিনি।
লিটনের বাবা ইয়াকুব আলী বলেন, টানাটানির সংসারে ধারদেনা করে ছেলের জন্য ওষুধ কিনতে হচ্ছে। বড় স্বপ্ন ছিল ছেলেটা পড়ালেখা শেষ করে সংসারের হাল ধরবে। পরিবারের অভাব দূর হবে। কিন্তু আমাদের সাজানো স্বপ্ন এখন শেষ হয়ে গেল। সরকারিভাবে এখনও কোনো সহযোগিতা পাইনি।
পুরো শরীর জুড়ে গুলির ব্যথায় ছটফট করতে থাকা লিটন বলেন, গুলি লাগার পরে শরীরের প্রত্যেকটা জায়গা যেন অবশ হয়ে আছে। কোন কাজ করতে পারি না। বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না, বসেও থাকতে পারি না। এখন সরকারের কাছে একটি চাওয়া আমার গুলিগুলো যেন বের করে দেওয়া হয়। আমি যেন স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারি।
লিটনের বর্তমান চিকিৎসক ঠাকুরগাঁও জেনারেল হাসপাতালের সার্জারি বিশেষজ্ঞ ডা. শিহাব মাহমুদ শাহরিয়ার বলেন, ছররা গুলি যদি খুব অসুবিধা না হয় তাহলে এ সব গুলি বের না করায় ভালো। কারণ মাথায় যে ১৫টি গুলি আছে, এর জন্য ১৫বার তার অস্ত্রোপচার করতে হবে। এতে রোগীর আরও জটিল অবস্থা তৈরি হবে। এছাড়াও গুলিগুলো খুবই ছোট, কেটে সঙ্গে সঙ্গে বের করা যাবে এমনটিও না। প্রতিটি গুলি খুঁজে বের করা খুব ক্রিটিক্যাল। তবে কোন গুলির কারণে শরীরে ইনফেকশন বা পুঁজ বের হলে তখন সেটি বের করে আমরা চিকিৎসা দিই। তবে এত গুলি বের করা একেবারে সম্ভব না।
ঠাকুরগাঁওয়ে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হতাহতদের চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিকেল উইংয়ের দায়িত্বরত সদস্য রাকিব ইসলাম বলেন, উন্নত চিকিৎসার মাধ্যমে লিটনের শরীরের গুলিগুলো যদি বের করা যায় তাহলে তিনি দ্রুত স্বাভাবিক সময়ে ফিরে আসবেন।
তবে এই চিকিৎসার জন্য প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ অর্থ যা জোগাড় করা সম্ভব নয় তার দরিদ্র পরিবারের পক্ষে। এ জন্য সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানদের কাছে তার পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ জানান এ সমন্বয়ক।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : ঠাকুরগাঁও বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন গুলিবিদ্ধ
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh