কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তঘেঁষা প্রত্যন্ত ইউনিয়নের নাম রামকৃষ্ণপুর। এই ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের সীমানা নির্ধারণী নদী মাথাভাঙার তীরবর্তী গ্রাম- ঠোটারপাড়া। ১৯২৪ সালে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘৩৪ নং পি এম ঠোটারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।’
শতাব্দী প্রাচীন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কুষ্টিয়ার সীমান্ত অঞ্চলে শিক্ষার প্রসারে অবিস্মরণীয় অবদান রেখে চলেছে। এ বছর ২১ ডিসেম্বর জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনে হলো এই বিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উদযাপন। একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতবর্ষ উদযাপন, অনুষ্ঠান ঘিরে চরাঞ্চলটির মানুষ বিশেষ উৎসব আয়োজনে মেতেছিল। প্রতিটি বাড়িতে দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে এসেছিল আত্মীয়স্বজন; যারা একসময় এ অঞ্চলেই বসবাস করত। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে পদ্মার ভাঙনে ১৯৯৮ সালে স্কুলটিসহ পুরো গ্রাম-এলাকা বিলীন হলে অনেকেই দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়েন। কয়েক বছরের ব্যবধানে এলাকাটি পুনরায় জেগে উঠলেও গ্রামে ফেরা হয়নি তাদের অনেকের। শতবর্ষের এই অনুষ্ঠান ঘিরে তারা সবাই ছুটে আসেন এই চরে!
পদ্মা নদীর শাখা মাথাভাঙ্গার তীরবর্তী ঠোটারপাড়া গ্রাম সবুজে ঘেরা, বর্তমানে যার প্রায় চারপাশেই নদী। গাছপালা আর সবুজ ফসলের হাতছানিতে এক অপরূপ পরিবেশ বিরাজ করছে এখানে। শিক্ষার্থীরা এই বিদ্যালয়ের আঙিনায় শুধু বিদ্যার্জনই নয়, প্রকৃতির সান্নিধ্যও পাচ্ছে অনায়াসে।
১৯২৪ সালে সর্বপ্রথম বিদ্যালয়টির সূচনা হয়েছিল স্থানীয় বোর্ডঘরসংলগ্ন লোকনাথপুর নামক স্থানে। তবে পদ্মার ভাঙনে স্কুলটি ফের ঠোটারপাড়া গ্রামে স্থানান্তরিত হয় এবং এর নাম হয় ৩৪ নং পিএম ঠোটারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ‘পিএম’ শব্দের অর্থ- ‘পঞ্চ মহল্লা’, যা এই অঞ্চলের পাঁচটি মহল্লার মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার প্রতীক। পাঁচটি মহল্লা বা গ্রামের ছেলেমেয়েদের মাঝে শিক্ষার আলো বিস্তারে এই বিদ্যালয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
সে সময় আশপাশের দশ গ্রামে কোথাও প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল না। বিদ্যালয়টির প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষানুরাগী সায়েদ আলী সরকার, ১৯৩৪-৩৫ সালের দিকে নিজ জমিতে বিদ্যালয়টি লোকনাথপুর থেকে স্থানান্তর করে পুনর্নির্মাণ করেন। তার ত্যাগ ও শিক্ষার প্রতি গভীর ভালোবাসার ফলস্বরূপ স্কুলটি গ্রামবাসীর শিক্ষার আলোকবর্তিকা হয়ে ওঠে।
তার অবর্তমানে বড় ছেলে আবু বক্কর এই দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালে সরকারের সহায়তায় প্রথম পাকা ভবন নির্মিত হয়। এর আগে বিদ্যালয়টি টিনশেড ছিল। এরপর ১৯৯৩-৯৪ সালের দিকে দ্বিতীয় পাকা ভবন নির্মিত হয়, যা শিক্ষার্থীদের জন্য আরো উন্নত শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করে। তবে ১৯৯৮ সালের শেষের দিকে পদ্মার ভাঙনে বিদ্যালয় ভবনটি ভেঙে যায়। এই ভাঙনে পুরো ঠোটারপাড়া গ্রাম বিলীন হয়। এ কারণে বিদ্যালয়টি ১৯৯৯ সালে ক্রফোর্ডনগরে একটি টিনশেড ভবনে পুনরায় চালু হয়। পদ্মার প্রাকৃতিক পরিবর্তনে জেগে ওঠে ঠোটারপাড়া গ্রাম। ২০১৪ সালে আবারও ঠোটারপাড়া গ্রামে ফিরে আসে এলাকাবাসীর প্রাণের বিদ্যালয়টি।
নতুন দ্বিতল ভবন নির্মাণের মাধ্যমে ৩৪ নং পিএম ঠোটারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় তার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার করে। বিদ্যালয়ের প্রথমদিকের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকের মধ্যে সিরাজ মাস্টার, পাশা মাস্টার, বাকের মাস্টার ও আবুল কাশেম। তাদের সমন্বিত প্রচেষ্টা বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ও স্থানীয় শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশে এক ব্যাপক ভূমিকা রাখে।
ঠোটারপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি উদযাপন উপলক্ষে সপ্তাহব্যাপী আলোকসজ্জিত থাকে স্কুলপ্রাঙ্গণ। আর ‘দ্বিতীয় জীবন’ নামে একটি বিশেষ প্রকাশনা ছাপা হয়েছে। যেখানে বিদ্যালয় ঘিরে প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্মৃতিচারণা, বিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থী, এলাকার জনমানস গঠনে প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা, পদ্মায় বিলীন হওয়ার পর গ্রামান্তরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়া মানুষের শৈশব-কৈশোরের স্মৃতিচারণা; শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ছবি, মোবাইল নম্বর ও ঠিকানা ঠাঁই পেয়েছে। ২১ ডিসেম্বর দিনভর আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে ছিল দেশের নানান প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া প্রাক্তন শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গ্রামবাসীর অংশগ্রহণে স্কুলমাঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশন; স্মৃতিচারণা-আলোচনা অনুষ্ঠান। যেখানে সবার চোখে-মুখে ছিল দুই যুগেরও বেশি সময় পর একে-অপরকে দেখার; কথা বলার অসামান্য আনন্দঝিলিক।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত প্রবীণ শিক্ষাবিদদের দাবি- শতবর্ষের পথচলায় বিদ্যালয়টি শুধু শিক্ষাদানই করেনি, বরং প্রজন্মের পর প্রজন্মকে আলোকিত করেছে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh