এখনও থেমে নেই কীর্তনখোলা নদীর দখল-দূষণ

গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণআন্দোলনে পতন ঘটে আওয়ামী লীগ সরকারের। এরপর নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠন হয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে ক্ষমতার পালাবদল হলেও এখনো দখলমুক্ত হয়নি বরিশালের কীর্তনখোলা নদীর দু-পাড়।

বরং সরকার পরিবর্তনের পর গত কয়েকমাসে দখলের মাত্রা আরো দ্বিগুন বেড়েছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা। তাদের অভিযোগ প্রশাসনের নাকের ডগায় দখল-দূষণ হলেও, প্রতিরোধে কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না।

এর ফলে ধীরে ধীরে নদী যেমন সরু হচ্ছে, তেমনি হারাতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী কীর্তনখোলা নদীর চিরচেনা রূপ। এমন পরিস্থিতিতে নদী বাঁচাতে প্রশাসনের জরুরি উদ্যোগ নেয়ার দাবি জানিয়েছেন সচেতন মহল।

সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, কেউ নদীর পাড় দখল করে গড়ে তুলছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা, কেউ গড়ে তুলছে ইট, বালু, পাথর, কয়লা বিক্রির খোলা ও নৌযান তৈরির ডকইয়ার্ড।

এছাড়া নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে জেগে ওঠা রসুলপুর চর, মোহাম্মদপুর চর, দপদপিয়া, কর্ণকাঠী, পলাশপুর, চর বাড়িয়া এবং শায়েস্তাবাদসহ বিভিন্ন চর দখল করে আছে প্রভাবশালীরা।

দেখা যায়, সদর উপজেলার চর আইচা এলাকায় বাঁশের বেড়া দিয়ে বালু ফেলে দখল করা হচ্ছে কীর্তনখোলা নদী। পাশেই দখল করা জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।

শুধু চর আইচায় নয়, নগরীর সাগরদী ধান গবেষণা রোড, আমানতগঞ্জের বেলতলা এলাকাজুড়ে চলছে কীর্তনখোলা নদী ভরাট এবং দখলের মচ্ছব। তবে দখলদাররা বলছেন, এসব জমির কাগজপত্র আছে তাদের কাছে। কিন্তু কাগজপত্র দেখতে চাইলে দেখাতে পারেননি।

আবার কারোর দাবি, নদী ভাঙনের আগে নদীর যেসব জায়গায় তাদের জমি ছিল সেই দাগ হিসেব করে ভরাট করেছেন তারা। তাতে নদী দখল হয়নি, দাবি তাদের।

স্থানীয়রা বলছেন, নদীর সাথে সংযোগ দেয়া সুয়ারেজ লাইনের ময়লা আবর্জনার স্তূপকে ঘিরে প্রতিনিয়তই বিষাক্ত হয়ে উঠছে কীর্তনখোলা নদীর পানি।

নগরীর ধান গবেষণা রোডের মিজানুর রহমান নামে এক বাসিন্দা জানান, স্বৈরশাসকের আমলে যে যেখান থেকে পেরেছে কীর্তনখোলা নদী দখল করেছে। একই অবস্থা এখনো বিরাজমান। ক্ষমতার পালাবদলের পর অনেকেই নিজেদের বিভিন্ন দলের লোক পরিচয় দিয়ে দখল করছে নদীর দুই পাড়ের বিভিন্ন অংশ।

তিনি আরো বলেন, বিভিন্ন শিল্প কারখানা এবং প্রতিষ্ঠানের সুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমে ময়লা-আবর্জনা যাচ্ছে নদীতে। সব মিলিয়ে দখল-দূষণে একাকার অবস্থা কীর্তনখোলা নদীর।

উন্নয়ন কর্মী লিটন হোসেন বলেন, কীর্তনখোলা দখলমুক্ত করতে পতিত সরকারের আমলে অনেকবার আন্দোলন করেছি। কিন্তু দখলদাররা সেসময়ের প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের কবল থেকে কীর্তনখোলা মুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এখনো যে যার মতো করে নদী দখল করে নিচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন বরিশালের তথ্য বলছে, গত ৪০ বছরে কীর্তনখোলা নদীর দু’পাড় দখল করেছে প্রায় ৫ হাজার ১৯২ জন প্রভাবশালী দখলদার।

খোদ বিষয়টি স্বীকার করেছেন বরিশাল বিআইডব্লিউটিএ প্রকৌশল শাখার সাবেক এক নির্বাহী প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করে বলেন, আওয়ামী সরকারের সময় প্রতিবছরই অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদের জন্য তালিকা হয়েছে। কিন্তু উচ্ছেদ কার্যক্রম তালিকায় সীমাবদ্ধ থেকে যায়। সাবেক দুই মেয়রের কারণে এমনটি হয়েছে বলেন মনে করেন এই কর্মকর্তা।

এই কর্মকর্তার মতে, নদীর দু-পাড়ে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান বিগত সরকারের লোকজনই দখলে রেখেছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী লিংকন বাইন বলেন, রাজনৈতিক সরকারের সময় যে যার মতো করে নদীর দুই পাড় দখল করে নিয়েছিল। বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলেও প্রশাসনের সঠিক তদারকির কারণে আবারো দখল বাণিজ্য হচ্ছে। এখনই দখলমুক্ত করা না গেলে আর কখনোই সম্ভব হবে না বলেন মনে করেন তিনি।

পরিবেশবিদ ও বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, অন্তর্বর্তী  সরকার দেশের নদীর পাড়ের অবেধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। সেক্ষেত্রে কীর্তখোলা নদীর বিষয় নিয়ে জেলা প্রশাসনের একটি সভায় আলোচনা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় দখল, দূষণের প্রক্রিয়া আরো বেড়েছে। নদী থেকে যে যার মতো বালু ড্রেজার দিয়ে উত্তোলন করছে।

তিনি বলেন, আগামী কয়েকদিনের ভিতরে দখল বাণিজ্যর সাথে জড়িতদের তালিকা করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক এবং পরিবেশ উপদেষ্টা বরাবর স্বারকলিপি দেয়া হবে। তারা ব্যবস্থা না নিলে কঠোর আন্দোলনে যাবার হুঁশিয়ারি দেন বাপার এই নেতা।

যেভাবে দূষণ হচ্ছে নদী :

গ্লোবাল ক্যাপসুল লিমিটেড, কেমিস্ট ল্যাবরেটরি লিমিটেড, অপসোনিন ফার্মা লিমিটেড, রেফকো ল্যাবরেটরিজ লিমিটেড, ইন্দোবাংলা ফার্মাসিউটিক্যালসসহ বেশ কিছু কলকারখানা কীর্তনখোলা নদীর তীরে অবস্থিত। এসব কারখানার সুয়ারেজ লাইন যুক্ত এ নদীর সাথে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যবহৃত বিষাক্ত কেমিক্যাল এবং বর্জ্য বিভিন্নভাবে কীর্তনখোলা নদীতে সরাসরি নির্গত হচ্ছে।

এছাড়া নদীর পাড় এলাকায় গড়ে ওঠা বস্তিবাসীর মল-মূত্র ও ব্যবহৃত বর্জ্য ফেলা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। এসব কারণে নদীর পানি দিন দিন ব্যবহার অনুপযোগীসহ বাড়ছে দূষণের মাত্রা।

এদিকে, প্রতিদিন বরিশাল-ঢাকাসহ অভ্যন্তরীণ রুটে নৌযানের যাত্রীদের ব্যবহৃত উচ্ছিষ্ট এবং বন্দরে ফেরার পর লঞ্চের ময়লা-আবর্জনা নদীতে ফেলছে পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। এতে নদীর তলদেশে পলিথিন আর প্লাস্টি জমাট বেঁধেছে। যা নদী ড্রেজিং বা মাছ ধরার জাল ফেলতেই উঠে আসছে।

নাব্যতা সংকট :

নিয়মিত ড্রেজিং না করায় ঢাকা-বরিশাল নৌপথের বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে নাব্যতা সংকট। এ কারণে ডুবোচরে প্রায়ই আটকে যাচ্ছে যাত্রীবাহী লঞ্চ ও পণ্যবাহী জাহাজ। এতে লঞ্চ, জাহাজসহ নৌযান চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে। প্রায়শই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। ফলে দুর্ভোগ বাড়ছে যাত্রীদের।

এরইমধ্যে মেঘনা নদীতে নাব্যতা সংকটের কারণে নৌপথের হিজলার মিয়ার চ্যানেল দিয়ে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে ১০ কিলোমিটারের বেশি পথ ঘুরে কালীগঞ্জ দিয়ে লঞ্চ চলাচল করছে।

তবে নৌযান চলাচল স্বাভাবিক রাখতে নৌপথের বিভিন্ন এলাকায় ক্যাপিটাল ও হাইড্রোলিক ড্রেজার দিয়ে নদী খনন করছে বিআইডাব্লিউটিএ।

বরিশাল বিআইডব্লিউটিএর উপ-পরিচালক সেলিম রেজা বলেন, কয়েকদিন হলো এখানে যোগদান করেছি। এই সময়ের  মধ্যে কীর্তনখোলা নদীর সীমানা প্রাচীরের বিষয়টি নিয়ে জেলা প্রশাসকের সাথে আলোচনা করেছি। একই সাথে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়া হবে।

সবশেষ ২০২১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর ৬০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নদী দখলের তালিকা প্রস্তুত জানিয়ে বারবার হুঁশিয়ারি দিলেও, অদৃশ্য শক্তির জোরে শক্তপোক্তভাবে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয় না বলে অভিযোগ নদী গবেষকদের।

নদী-খাল বাঁচাও রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব কাজী এনায়েত হোসেন শিবলু বলেন, কীর্তনখোলা নদীর আশপাশ দখলে যারা জড়িত তারা সবাই কোনো না কোনো দলের সাথে সম্পৃক্ত। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে তারাই সিন্ডিকেট করে নিয়ন্ত্রণ করে। তাই প্রশাসন তালিকা করেও দখল বাণিজ্য ঠেকাতে পারবে না।

পরিবেশ অধিদফতর বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের পরিচালক মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, কীর্তনখোলা নদী দূষণমুক্ত রাখতে কলকারখানাগুলো মনিটরিং করা হচ্ছে। বরিশাল সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন এবং পরিবেশ অধিদফতর মিলে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে নদী দূষণ রোধে কাজ করা হবে বলে জানান এই কর্মকর্তা।

এ ব্যাপারে বরিশালের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন বলেন, অবৈধ দখলদারদের তালিকা ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি বাজেটও দেয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলেই নদীর দুই পাড়ে দখলে থাকা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। নদী দখলদার যেই হোক কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh