ছাত্রসমাজকে হালকাভাবে নেওয়া ঠিক না

উত্তরবঙ্গের অন্যতম একটি জেলা দিনাজপুর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গোটা দেশ যখন উত্তাল, সেই সময় পিছিয়ে ছিল না দিনাজপুর জেলার আপামর ছাত্র-জনতাও। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া এক দফা দাবিতে সেই সময় দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে দিনাজপুরের ছাত্র-জনতা। এই আন্দোলনে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। দিনাজপুরে মূলত ব্যাপক সংঘর্ষ হয় ৪ আগস্ট। বৈষমবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর এদিন পুলিশ অতর্কিত টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছোড়ে, যাতে বহু ছাত্র-জনতা আহত হয়। 

দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রথমে আহত এবং কিছুদিন পর শহীদ হন রাহুল ইসলাম। এ বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সম্মুখসারির নেতা একরামুল হক আবিরের বয়ান শোনা যাক।

১৬ জুলাই ছাত্রলীগ ও যুবলীগ আমাদের অনেক শিক্ষার্থীকে মেরে আহত করে। সেই সময় আহতদের তারা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে দেয়নি। হাসপাতালের ডাক্তাররাও চিকিৎসা দিতে ভয় পেতেন। আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো; হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ ছিল না। অনেকে বাসায় চিকিৎসা নেয়, আবার অনেককে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়। এভাবেই চলছিল জুলাইয়ের আন্দোলনের দিনগুলো। ৪ আগস্ট শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের আন্দোলন কর্মসূচি চলছিল।

 পলিটেকনিক মোড় থেকে দিনাজপুরের ছাত্র-জনতার মিছিল বড় মাঠের দিকে শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু শান্তিপূর্ণ মিছিলটি জোড়া ব্রিজ আসামাত্র পুলিশ বাধা দেয়। একপর্যায়ে  টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছোড়া শুরু করলে ছাত্র-জনতা উত্তেজিত হয়ে যায়। তারা ক্ষিপ্ত হয়ে হুইপ ইকবালুর রহিমের বাড়ি ভাঙচুর করে। আমাদের একটা গ্রুপ লিলিমোড়ের দিকে যায়। আর একটা গ্রুপ সদর হাসপাতাল মোড়ের দিকে যায়। পরের গ্রুপে রাহুল ছিল। সদর হাসপাতালের দিকে আমরা গেলে পুলিশ টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। এতে প্রায় ২০০ থেকে ৩০০ জনের মতো আহত হয়। রাবার বুলেটের একটি গুলি রাহুলের পায়ে এসে লাগে, সেই সঙ্গে টিয়ার শেল তার নাকে এসে ঢোকে। এ সময় তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল। কিছুদিন পর তার প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট বেড়ে গেলে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। সেখানেই শহীদ হন রাহুল।

বৈষম্যবিরোধী ৪ আগস্টের ছাত্র আন্দোলনে যোগ দেওয়া দিনাজপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, “দিনাজপুরের ছাত্র-জনতা ৪ আগস্ট পলিটেকনিক মোড়ে আন্দোলনের ডাক দেয়। আমার বড় ভাই আব্দুর রউফকে আন্দোলনে যেতে দেখলাম। সে বলল, আমি আন্দোলনে যাচ্ছি, তুই যাস না। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আমার বন্ধু সাদেক আন্দোলনে যাওয়ার জন্য ফোন করার পর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। চৌরঙ্গী মোড় থেকে অটো নিয়ে পলিটেকনিক মোড়ে গিয়ে দেখি পলিটেকনিক মোড় স্লোগানে মুখরিত। ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, সরকার সরকার।’ ঠিক হলো মিছিল  পলিটেকনিক মোড় থেকে শুরু করে দিনাজপুর বড় মাঠে গিয়ে শেষ হবে এবং সেখানে আলোচনা সভা করা হবে। পলিটেকনিক মোড় থেকে যখন মিছিল নিয়ে জোড়া ব্রিজের কাছাকাছি এলাম, তখনই পুলিশ বাহিনী আমাদের ওপর অতর্কিত টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে লাগল। আমরা যে যেদিকে পারছি ছুটে পালালাম। টিয়ার শেলের ধোঁয়ায় কিছু দেখতে পারছিলাম না। এক বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিলাম, তারা পানি ও অন্যান্য জিনিস দিয়ে সাহায্য করল। আমরা একত্রিত হয়ে আবারও সামনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। পুলিশ পিছু হটতে শুরু করল। আমরা ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগোতে শুরু করলাম।”

এদিকে পুলিশের টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছোড়া থামছেই না। আমি মোবাইলে লাইভ দিতে দিতে সামনের দিকে এগিয়ে চললাম। এক পর্যায়ে পুলিশ পিছু হটতে হটতে জেলা আদালতের সামনে অবস্থান নিল। তাদের সঙ্গে আরো কিছু নতুন পুলিশ সদস্য যুক্ত হয়। এক পর্যায়ে তারা এলোপাতাড়ি টিয়ার শেল, রাবার বুলেট ছোড়া শুরু করলে অনেক ছাত্র আহত হয়। আবারও আমরা পিছু হটতে বাধ্য হলাম। কিন্তু খুব কষ্টের বিষয় ছিল, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আহতদের চিকিৎসা দিতে অনাগ্রহ প্রকাশ করল। পুলিশ বাহিনী সদর হাসপাতাল সামনে তাদের অবস্থান শক্ত করল। সবাই এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করে খুব ক্লান্ত। তাই সামনে এগোতে পারছি না। কিন্তু আন্দোলনের মাঝে স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, আশপাশের  মানুষ আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও জনতাকে পানি, শরবত, শুকনা খাবার দিয়ে সাহায্য করছিল, যা আমি কখনই ভুলব না। শরীর এতটাই ক্লান্ত হয়ে পড়ল যে নিজেকে আর আন্দোলনে জড়াতে পারলাম না। এক জায়গায় বসে রইলাম। আশপাশের সবাই বসে চিন্তা করতে লাগল, এ আন্দোলন সফল না হলে সবার অবস্থা শোচনীয় হবে। বিকেল গড়িয়ে পড়তেই বড় ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। সেখানে আর বেশিক্ষণ অবস্থান না করে বন্ধু সাদেকসহ বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিলাম। জীবনের প্রথম আন্দোলন এতটা উদ্দীপনা ও সাহসের মধ্যে কাটিয়েছি, কখনো বোঝাতে পারব না। পরের দিন ৫ আগস্ট দিনটিকে যে এত সুন্দর করে পাব, কখনো ভাবতে পারিনি। বিজয়ের উল্লাস কত আনন্দের হয় তা বোঝানো মুশকিল। তাই আমি বলতে চাই, ছাত্রসমাজকে কখনো কেউ হালকাভাবে নিয়েন না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh