জুলাই মাস, চারদিকে চলছে কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে আন্দোলন- এইদিকে আমার চলছে এইচএসসি পরীক্ষা। তার মাঝে হঠাৎ ৬ জুলাই খবরে দেখতে পাই আব্দুল আজিজ নামের এক ছাত্রের নেতৃত্বে স্বল্প পরিসরে ফেনীতে আন্দোলন চলছে। ১৪ জুলাই দেখলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছাত্ররা ফেনীর ডিসির কাছে স্মারকলিপি প্রদান করল।
১৫ তারিখ সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, বিষাদময় করে তুলল মনটাকে। ভাবলাম- যেভাবেই পারব আন্দোলনের পক্ষে কাজ করব। আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে একের পর এক পোস্ট করতে থাকলাম ফেসবুকে। আমার তৎপরতা দেখে সেই আবদুল আজিজ ভাইয়ের মেসেজ আসে, তিনি আমার সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান এবং আব্দুল্লাহ আল জোবায়ের ও মুহাইমিন তাজিমের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেন। পরদিন (১৬ জুলাই) বিকেল ৪টায় এক গোপন বৈঠকে বসলাম আমরা। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিই পরদিন সকালে অবস্থান নেব শহরের ট্রাঙ্ক রোডে অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। সেদিন সকাল থেকেই শহীদ মিনার, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর মহিপালসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠন অবস্থান নেয়। ট্রাঙ্ক রোডের দিকে যত শিক্ষার্থী যাচ্ছে, তাদের সবার মোবাইল চেক করছিল, সন্দেহজনক কিছু পেলেই মারধর এবং আটক করছিল। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা ফেনী বড় মসজিদের পাশে বড় বাজার সড়ক হয়ে শহরের প্রধান সড়কে ওঠার চেষ্টা করতেই পুলিশের বাধার মুখে পড়ি। পরে ফেনীর গ্রিনটাওয়ারসংলগ্ন রোড হয়ে ট্রাঙ্ক রোডে উঠতে সক্ষম হলাম, মিছিলের প্রথম তিন সারিতে ছাত্রী এবং পেছনে ছাত্ররা অবস্থান করছিল। আমাদের জমায়েত ট্রাঙ্ক রোডে উঠে দোয়েল চত্বর পেরিয়ে শহীদ মিনারের কাছাকাছি পৌঁছালে শুরু হয় হামলা। সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়, কিছু ছাত্রছাত্রীকে অবরুদ্ধ করে মারধর করা হয়। আবার ইসলামপুর রোডে একত্রিত হয়ে আমরা দুপুর পর্যন্ত অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হই। দুপুর ২টার দিকে ওই দিনের মতো প্রগ্রাম শেষ করে ফিরে যাই সবাই। আটককৃতদের ফেনী পিটিআই মাঠে জড়ো করে রাখা হয়েছিল, বিকেল ৪টার দিকে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়।
১৮ জুলাই ফেনী বড় মসজিদসংলগ্ন এলাকায় পুলিশ আমাদের ওপর হামলা চালায় এবং ছররা গুলি ছোড়ে। ১৯ তারিখ জুমার নামাজের পর ফেনীর জহিরিয়া মসজিদ থেকে বের হয়ে ট্রাঙ্ক রোডে সফলভাবে অবস্থান কর্মসূচি পালন করি আমরা। সেদিন বিকেলে আবারও ট্রাঙ্ক রোডের দিকে রওনা হলে বাধা দেয় পুলিশ। বাধা উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীরা ফেনী বড় মসজিদের দিকে এগিয়ে যেতে চাইলে এক পুলিশ কর্মকর্তা ফাঁকা গুলি ছোড়েন, তারপরও বড় মাসজিদের সামনে এক ঘণ্টার অবস্থান কর্মসূচি করি আমরা। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় জমায়েত সেভাবে হচ্ছিল না, কোনোভাবে ৮-১০ জন একত্রিত হতে পারলেই কারিফিউয়ের মধ্যেও মিছিল করেছি। ইন্টারনেট কিছুটা সচল হলে ৩১ জুলাই বুধবার সকাল ১১টায় ফেনী প্রেস ক্লাবের সামনে সব শিক্ষার্থীকে জড়ো হতে আহ্বান করা হয়। কিন্তু কোনোভাবেই অবস্থান নেওয়া সম্ভব হয়নি। ১ আগস্ট সন্ধ্যায় মোমবাতি প্রজ্বালনের কর্মসূচি ঘোষণা হয়, মাগরিবের নামজের পর ফেনী প্রেস ক্লাবসংলগ্ন বড়বাজার রোডে মোমবাতি প্রজ্বালন কর্মসূচি পালন করা হয়, পুলিশী বাধার পরও।
২ আগস্ট দিবাগত রাতে চট্টগ্রামের সমন্বয়ক এবং কেন্দ্রীয় সহসমন্বয়ক খান তালাত মাহমুদ রাফি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজে আজিজ, তাজিম, সোহাগ, ঝুমুরসহ ফেনী জেলার ১৯ জনের একটি সমন্বয়ক কমিটি প্রকাশ করেন, যেখানে আমিও ছিলাম একজন। রাতেই সেই কমিটি থেকে ২ আগস্ট জুমার নামাজের পর ফেনী জহিরিয়া মসজিদ থেকে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেওয়া হয়। বৃষ্টির মধ্যেও ছাত্রছাত্রীদের জোয়ার নেমে আসে। সেদিনের কর্মসূচি শেষে ৩ আগস্ট দুপুরে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এদিন ফেনীতে ব্যাপক হতাহত হয়, তবু ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে সেদিনও সফল হই আমরা।
ওই দিনই একদফা আন্দোলনের ঘোষণা আসে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে। আমরা ঠিক করি ৪ আগস্ট সকাল ১১টায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ফেনীর মহিপাল এলাকায় গণজমায়েত করব। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করি। সকাল সাড়ে ১১টার আগেই প্রায় ১০ হাজারের অধিক ছাত্র-জনতা উপস্থিত হয়। দুজন ম্যাজিস্ট্রেটসহ পুলিশ ও বিজিবির সদস্যরা অবস্থান নেন জমায়েতের কাছাকাছি। দুপুর দেড়টার দিকে বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে নামাজ পড়তে শুরু করে অনেকে, একদল নামাজ পড়ার সময় অন্য আরেকটি দল পাহারা দিতে থাকে। দুটি জামাত শেষ হয়ে তৃতীয় জামাতের সালাম ফেরাবে এমন সময় মহিপাল ফ্লাইওভারের নিচে এবং ওপরে অবস্থানরত ছাত্র-জনতাকে লক্ষ্য করে অতর্কিত গুলি চালাতে থাকে। ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই সবাই। জমায়েত তিন ভাগে ভাগ হয়ে যায়, ছোট একটি অংশ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনের দিকে সরে গিয়ে অবস্থান নেয়, আরেকটি অংশ মহিপাল পাসপোর্ট অফিসসংলগ্ন রাস্তার দিকে এবং বৃহৎ একটি অংশ পিছু হটে ফেনী-নোয়াখালী মহাসড়কের দিকে। পাসপোর্ট অফিস সংলগ্ন এলাকায় গুলি খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে চারজন, তার মধ্যে একজন মারা না গেলে তার মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া চলতে থাকে পুরো এলাকায়। আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের অস্ত্রের বিপরীতে ইটপাটকেলে জবাব দিতে থাকে ছাত্র-জনতা। আর ওদিকে বৃষ্টির মতো ছররা গুলি ছুড়ে যাচ্ছে পুলিশ। বুলেটের আঘাতে একের পর এক ছাত্র-জনতা হতাহত হচ্ছে, তবু কেউ থেমে নেই। এক দল পিছু হটলে আরেক দল এগিয়ে যাচ্ছে। ছররা গুলিতে আহত হই, সঙ্গে টিয়ার শেলের ধোঁয়া তো আছেই। হঠাৎ করে কানে শুনতে পাচ্ছিলাম না, চোখে ঝাঁপসা দেখছিলাম, মনে হচ্ছিল পায়ের নিচের মাটি সরে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে আর দাঁড়াতে না পেরে রাস্তায় বসে পড়ি। দুজন আমাকে ধরাধরি করে তুলে নিয়ে আদর্শ হাউজিং এলাকার একটি ভবনের দোতলায় নিয়ে আসে। দেখলাম প্রচুর আহত মানুষের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন একজন নারী, উপস্থিত অন্য নারীরা আহতদের দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন। সেখানে আমার শরীর থেকে সাতটি ছররা গুলি বের করে আনা হয়। এরপর আবারও বেরিয়ে পড়ি আন্দোলনে যোগ দিতে।
বিকেল ৩টা ৩০-এর দিকে সন্ত্রাসীদের বুলেট শেষ হয়ে যায়, তখন তারা পিছু হটে। আমরা আবারও মহিপাল ফ্লাইওভারের ওপরে এবং নিচে অবস্থান নিতে সক্ষম হই। জানতে পারলাম সাত-আটজনের মতো শহীদ হয়েছে এবং আহত ৫০০-এর অধিক। এদিকে সরকারি-বেসরকারি কোনো হাসপাতাল চিকিৎসা দিতে চাইছিল না। ফেনী ডায়াবেটিস হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। বিকেল ৪টা ৪৫ মিনিটের দিকে চাচার বাসায় ফিরে যাই। অনেকেই বাসায় ফিরতে পারেনি, অপরিচিত মানুষের বাসায় আশ্রয় নিয়েছিল। সন্ধ্যায় আম্মু-আব্বু এলেন চাচার বাসায়। অনেক কথা বললেন, চুপ হয়ে থাকলাম। ২ ঘণ্টা পর আব্বু-আম্মু আমাকে চাচার বাসার একরুমে দরজা বন্ধ করে রেখে বাসায় ফিরে গেলেন। ছররা গুলির আঘাতের স্থানগুলোতে ব্যথা করছিল ভীষণ, কষ্টকর এক রাত কাটালাম। ৫ আগস্ট সকালে অনেকেই লং মার্চের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে, আমার ইচ্ছা থাকলেও যেতে পারছিলাম না, খারাপ লাগছিল। দুপুর ১টা ১৭ মিনিটের দিকে সহযোদ্ধা আব্দুল্লাহ আল মাহফুজ ফোন করে বলল, ‘ফ্যাসিস্ট পালিয়েছে’। খুশিতে আমি আত্মহারা হয়ে সবাইকে বলে বেড়াচ্ছি, কিন্তু কেউ বিশ্বাস করতে পারছিল না। দুপুর ২টার দিকে বিজয় মিছিল করার উদ্দেশে কিছু মানুষ ট্রাঙ্ক রোডে অবস্থান নিলে জেল রোড ও মাস্টারপাড়ার সংযুক্ত স্থান থেকে ছররা গুলি চালায় সন্ত্রাসীরা। তাদের পাল্টা ধাওয়া দিলে পালিয়ে যায়। আমি কৌশলে চাচার বাসা থেকে বেরিয়ে পরিচিতজনদের ফোন করি। সবাই এলে মিছিল নিয়ে ট্রাঙ্ক রোডে যাই। এলাকা থেকে শুরু করা ২০ থেকে ৩০ জনের মিছিলটি ট্রাঙ্ক রোড পৌঁছালে শেষপ্রান্ত আর দেখা যাচ্ছিল না।
লেখক: সহসমন্বয়ক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, ফেনী জেলা।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh