নোয়াখালীর দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলীয় উপজেলা সুবর্ণচরজুড়ে সবুজের সমারোহ। একসময়ের শস্যের ভান্ডার নামে পরিচিত এ অঞ্চলের কৃষিতে শুষ্ক মৌসুমে অভাবনীয় পরিবর্তন লক্ষণীয়। এখানে রবি মৌসুমে কৃষকরা শীতকালীন সবজি, বাদাম, মরিচ, ডাল, সরিষা, ছোলা বুট, রৌশন, পেঁয়াজ, মটরশুটি, খেসারি, ভুট্টা, তিল, মেথি, ধনিয়া, তরমুজ, কুমড়াসহ নানা জাতের রবিশস্য উৎপাদন করতেন কৃষক।
কিন্তু গত একদশক থেকে এ জনপদে বদলে গেছে কৃষির চিত্র। একসময় রবি মৌসুমে পানি সেচ ছাড়াই কৃষক উৎপাদন করত মূল্যবান রবিশস্য। আমনের মৌসুম শেষ হতেই রবি মৌসুমে এসব ফসল উৎপাদনে চলত মহা কর্মযজ্ঞ। এসব রবিশস্য স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি হতো সারা দেশে।
কালের বিবর্তনে কৃষিতে যুক্ত হলো উচ্চ পানি শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন উফশী ধানের বীজ, যা উৎপাদনে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়। উপকূলীয় এ অঞ্চলে প্রাকৃতিক পানির আধার সৃষ্টি না করায় কৃষক সেচের ৮০ শতাংশ পানি ভূগর্ভ থেকে অপরিকল্পিতভাবে উত্তোলন করে বোরো (ইরি) ধানের পানির চাহিদা মেটাচ্ছে। এতে করে ভূগর্ভের সুপেয় পানির স্তর গাণিতিক হারে নেমে যাচ্ছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির চরম হাহাকার চলছে এ জনপদে। শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষই এখন সুবর্ণচরের জন্য বড় অভিশাপ!
সরেজমিনে উপজেলার আটটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, কৃষকরা মৌসুমি ফসল চাষ না করে ৭০ শতাংশ ভূমিতেই বোরো (ইরি) ধানের চাষ করেছেন। ফলে যত্রতত্র ফসলি মাঠের পাশে, পুকুর পারে নিজেদের ইচ্ছামতো গভীর নলকূপ স্থাপন করে অপরিকল্পিতভাবে তুলছে ভূগর্ভের সুপেয় পানি। ধান চাষে ভূগর্ভের পানি অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে বাড়িঘরের (৭০০ থেকে ১২০০ ফুট) গভীর নলকূপে এখন আর পানি ওঠে না। এক কলসি সুপেয় পানির জন্য এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়িতে ছুটছে মানুষ। এতে গৃহস্থালির কাজেও দেখা দিয়েছে অচলাবস্থা। বিশুদ্ধ পানির অভাবে সুবর্ণচরের লাখ লাখ মানুষ দুর্বিষহ জীবন কাটাচ্ছে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০০০ সালে সুবর্ণচরে ৩৮ হাজার ৫০০ হেক্টর আবাদি ভূমির মধ্যে খালবিল ও পুকুরের পানি ব্যবহার করে মাত্র ২০০ হেক্টর ভূমিতে বোরো চাষ হতো। বাকি ভূমিতে কৃষক রবি ফসলের আবাদ করত। চলতি মৌসুমে ১৮ হাজার হেক্টর ভূমিতে বোরো ধানের চাষ করেছে কৃষক এবং দুই হাজার ৭৫০ হেক্টর ভূমিতে খেসারিসহ অন্যান্য ফসলের আবাদ করা হয়েছে। এই বোরো ধান চাষে ৫০ কোটি ১৬ লাখ ২০ হাজার ২৮০ কিউসেক পানি খরচ হচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র ২৫ শতাংশ পানি ব্যবহার হয় উপরিভাগ থেকে। চার লাখ ১৪০ কিউসেক পানি খরচ হচ্ছে প্রতি হেক্টর ধান চাষে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অতিমাত্রায় ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীলতা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে এ অঞ্চলে। বোরো (ইরি) ধান আবাদ কমিয়ে আনলে পানির সংকট ধীরে ধীরে কেটে যাবে। শুষ্ক মৌসুমে ধান চাষাবাদে কৃষককে নিরুৎসাহিত করতে হবে।
কৃষিকাজের জন্য প্রাকৃতিক পানির আধার সৃষ্টি করে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে তা মহাবিপর্যয়ের কারণ হতে পারে।
উচ্চ ফলনশীল ও উচ্চ পানি শোষণ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতের ধানের বীজ, সার, কীটনাশক এবং প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বছরজুড়ে। এদিকে রবিশস্য ধ্বংস করে ধান চাষ বিস্তারের কারণে পুরো জনপদে পানিশূন্য হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আমলেই নিচ্ছে না
কৃষি বিভাগ। বিএডিসির ছাড়পত্র ছাড়াই সেচের জন্য যত্রতত্র বিদ্যুৎ সংযোগ দিচ্ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। অন্যদিকে স্থানীয় চাষিরা অনুমোদন ছাড়াই এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ফুট গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলার কারণে উপজেলাজুড়ে তীব্র সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। সাধারণত নলকূপের গভীরতা হয় ৮০০ থেকে ৯০০ ফুট; ব্যবহার করা হয় ১.৫ ইঞ্চি পাইপ। কিন্তু সুবর্ণচরের অনেক নলকূপে ৪.৫ ইঞ্চি পাইপ ব্যবহার করে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার ফুট গভীর থেকে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্য বলছে, সুবর্ণচরে চাষাবাদের জন্য ২৪৫টি গভীর নলকূপের (সেচপাম্প) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর বাইরে চাষিরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে আরো তিন হাজারের বেশি সেচপাম্প স্থাপন করেছেন, তবে সেগুলো অনুমোদনহীন। একটি গভীর নলকূপ ভূগর্ভ থেকে প্রতি ঘণ্টায় এক হাজার ৮০০ কিউসেক পানি তোলে।
কোনো গবেষণা ও ভূগর্ভের পানির পরিমাণ সমীক্ষা না করেই গভীর নলকূপ অনুমোদন দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। ভূগর্ভে কী পরিমাণ পানির মজুদ রয়েছে কিংবা গভীর নলকূপ স্থাপনে পরিবেশ প্রকৃতি ও ভূগর্ভের ক্ষতিকর প্রভাবের বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়েই সর্বোচ্চ পানি শোষণকারী উফশী জাতের বীজ কৃষকের হাতে সরবরাহ করেছে কৃষি বিভাগ।
সুবর্ণচরের চরআমানউল্যাহ ইউনিয়নের বাসিন্দা বেলাল হোসেন বলেন, কখনো ভাবিনি সুপেয় পানির জন্য দুর্ভোগ পোহাতে হবে আমাদের। বাড়িতে গভীর নলকূপ থাকলেও পানি উঠছে না। অন্য গ্রাম থেকে অনেক কষ্টে সুপেয় পানি সংগ্রহ করছি।
চরমজিদ গ্রামের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় মাত্র একটি গভীর নলকূপে পানি পাওয়া যায়। আর সেই নলকূপ ঘিরে শত শত মানুষের ভিড় এক কলসি পানির জন্য। সবার হাতেই কলস বা ড্রাম। চরমজিদের স্কুল শিক্ষক তাজ উদ্দিন বলেন, এই নলকূপটি কয়েক গ্রামের মানুষের ভরসা। কয়েক কিলোমিটার দূর থেকে নারীরা এখান থেকে পানি নিতে আসেন।
সুবর্ণচরে পরিবেশ নিয়ে কাজ করা ‘উপকূলীয় পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন বাংলাদেশ’ নামে একটি সংগঠনের আবদুল বারী বাবলু বলেন, সুবর্ণচরে বড় বড় খাল ও লেক সেচের আওতায় আনলে দুই লাখ হেক্টর জমি চাষ করা যাবে। ২০ কোটি কিউসেক পানি পাওয়া যাবে শুধু মেঘনা লেক কাজে লাগিয়ে।
সুবর্ণচরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন চন্দ্রকলির নির্বাহী পরিচালক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, কৃষি বিভাগের ভুল নীতির কারণেই সুবর্ণচরে পানির জন্য হাহাকার তৈরি হয়েছে। রবিশস্য অধ্যুষিত এলাকায় বোরো ধান চাষ না করার বিষয়ে কৃষি আইন আছে। অথচ স্থানীয় কৃষি বিভাগ এ আইন মানছে না।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. হারুন অর রশিদ বলেন, ভূগর্ভের পানি রক্ষায় ও নিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের লক্ষ্যে আমরা কৃষককে রবি মৌসুমে অন্যান্য লাভজনক ফসল চাষের পরামর্শ দিচ্ছি। বিএডিসির গভীর নলকূপ অনুমোদন বিষয়ে উপজেলা কৃষি অফিসের সঙ্গে সমন্বয়হীনতা আছে। ফলে কত পরিমাণ জমিতে কেমন পানি লাগবে, সেই তথ্য নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। চাষ অনুযায়ী গভীর নলকূপ বসানো হলে অবৈধ নলকূপ স্থাপন কমে আসত।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh